ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

শত বছরের ঐতিহ্য মেঘনার অতলে!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট সাজ্জাদুর রহমান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০১৪
শত বছরের ঐতিহ্য মেঘনার অতলে! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ফলকন, কমলনগর, লক্ষীপুর ঘুরে এসে: বাড়ি-ঘর হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে জীবনের গতিপথ। জীবিকার অবলম্বন থেকে পারিবারিক ঐতিহ্য, এমনকি সামাজিক কাঠামো অথবা শিশু-কিশোরদের লেখাপড়া পর্যন্ত।



প্রায় ১০০ বছরে গড়ে ওঠা সামাজিক কাঠামো কাঁচের টুকরোর মত ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কয়েকশ’ একর জমির মালিক বিনা চিকিৎসায় মারা যান। এক সময় সামাজিক প্রতিষ্ঠানের জন্য বিপুল পরিমাণ জমি দান করেছেন, তারা এখন অন্যের জমিতে মাথা গোঁজেন।

মাত্র দু’তিন বছরের ব্যবধানে লক্ষীপুরের মেঘনাতীরের উপজেলা কমলনগর এভাবেই বদলে গেছে। কোথাও ভাঙনের গতি কিছুটা কমলে আবার কোথাও বেড়ে যায় অস্বাভাবিকভাবে। এ এলাকার বহু ঐতিহ্যবাহী পরিবারের পুরানো ভিটে এখন মেঘনার বুকে। বাপ-দাদার শত শত এক জমি থাকলেও পরের প্রজন্ম এখন পথে বসেছে। পূর্বপুরুষের বিপুল সম্পত্তির মালিকানা এখন তাদের কাছে শুধুই ইতিহাস।

সূত্র বলছে, মেঘনার বুকে জেগে ওঠা চর কমলনগরের বয়স প্রায় দেড়শ’ বছর। এখানকার জনবসতি প্রায় একশ’ বছরের। পুরোনো ভোলার শাহবাজপুর, রামদাসপুর, নেয়ামতপুর, নোয়াখালীর কুশখোলা, ফরাশগঞ্জ, ভুলুয়া ও হাতিয়া এলাকা থেকে জনবসতি গড়ে তোলে কমলনগরে। বংশ পরম্পরায় শত বছরে এ বিস্তৃতি ঘটে গোটা কমলনগর জুড়ে। কিন্তু এখন তা ভাঙনের মুখে।

বছরে বছরে এই জনপদ ছোট হচ্ছে, আর এখানকার মানুষের ছুটছেন এদিক ওদিক।

লক্ষীপুরের ক্ষুদ্রতম উপজেলা এই কমলনগর এর আগেও দু’বার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। এবার নিয়ে তৃতীয়বারের মতো ভাঙছে এই জনপদ। ভাঙনের পর মেঘনা অববাহিকায় পলি জমে আবার মাথা তোলে ভূখণ্ড। স্বপ্ন জাগায় মানুষের মনে।

চর ফলকন ইউনিয়ন আর পাটোয়ারিহাট ইউনিয়নের সীমায় ঐতিহ্যবাহী লুধুয়া বাজার। বেশ জমজমাট বাজার। পাশে মাছ ঘাটের কারণে এ বাজার জেগে থাকে রাত-দিন। কিন্তু এ বাজার থেকে আধা কিলোমিটারের কম দূরে রয়েছে মেঘনার ভাঙন। বাজারটি টিকবে কি-না, তা নিয়ে শঙ্কা সবার মাঝে।

লুধুয়া বাজার রক্ষা নিয়ে এখন যে শঙ্কা, সেই শঙ্কাই ছিল বাতির খাল, কিংবা সাহেবের হাট নিয়ে। ওইসব বাজারের শেষ রক্ষা হয়নি। কোনোটি একেবারেই নি:শেষ হয়ে গেছে। আবার কোনোটি পিছু হটতে হটতে ‘দেওয়ালে পিঠ’ ঠেকে গেছে। মানে স্থান বদলের আর কোনো জায়গা নেই।

আরশাদ উল্লাহ পন্ডিত। মাতব্বর পরিবারের প্রধান। তার একার নামেই জমি ছিল ১৫০ একর। বাড়ি ছিল ৬ একর জমির ওপর। শুধুমাত্র বাড়ি থেকেই মাছ, ফল-ফসলে বছরে আয় হতো প্রায় ২০ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে নিজের জমি থেকে বছরে তার আয় ছিল প্রায় কোটি টাকা। মাতব্বর পরিবারের নামে ছিল মাতব্বর নগর। এই আরশাদ উল্লাহ চর ফলকন ইউনিয়নে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কোল্ড ইনজুরিতে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ঘটে তার।

কমলনগরের সব মানুষ মাতব্বর বংশের নাম জানেন। কিন্তু শুধুমাত্র ভাঙনের কারণে এতো বড় পরিবার ভেঙে চুরমার। কে কোথায় আছেন, কোনো খোঁজ নেই। এ পরিবারের একজন কামাল মাতব্বর চর কালকিনি ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন থাকা-খাওয়া নিয়ে তার কষ্টের শেষ নেই।

কমলনগরের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী পরিবার তালুকদার। এ পরিবারের সম্পদের পরিমাণ ছিল অন্তত ৩০০ একর। সবই মেঘনায় ডুবেছে। চর ফলকন ইউনিয়নে বাস্তুভিটা ছাড়া আর কিছুই নেই। সফদর আলী হাওলাদার আর সফর আলী হাওলাদার এ অঞ্চলের সম্পদশালীদের মধ্যে অন্যতম। তাদের পুরোনো বাড়ি অনেক আগেই বিলীন।

সাহেবের হাট ইউনিয়নে আবদুল গফুর তহশিলদার বাড়ির দরোজায় ছিল বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাদের দান করা জমিতেই গড়ে ওঠে এসব প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কিছুই নেই এখন। কে কোথায় আছেন, তা কেউ বলতে পারছেন না। বংশের সদস্যদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে অনেক আগেই।

কমলনগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন বহু চিত্র পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকজন জানালেন, ভাঙনের প্রভাব পড়েছে তাদের জীবনের সব ক্ষেত্রে। জীবিকার ধরন বদলে গেছে। নদী-নির্ভর জীবিকার কারণে অনেকেই নদীর কিনারে থাকতে চান। কেউ পারেন। আবার কেউ পারেন না। ফলে জীবিকার প্রয়োজনে পরিবারের সব সদস্যদের নিয়ে তাদের ছুটতে হয় শহরে। গত কয়েক বছরে এ উপজেলা থেকে স্থানান্তর হওয়া মানুষের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে।

সরেজমিনে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, ভাঙনের প্রভাব পড়ছে শিক্ষা ব্যবস্থায়ও। পরিবার স্থানান্তরিত হওয়ায় বহু ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকে আবার একই ক্লাসে ২-৩ বছর থেকে লেখাপড়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। লুধুয়া ফলকন ফয়জুন্নাহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এমন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর দেখা মেলে। ফলকন, কালকিনি, সাহেবেরহাটে পথে যেতে দেখা হয় এমন আরও কয়েকজন শিশু-কিশোরের সঙ্গে।

লুধুয়া ফলকন ফয়জুন্নাহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল করিম বলেন, নদী ভাঙনের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারে লেখাপড়ায় মারাত্মকভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। বাবা-মাকে সহায়তা করতে গিয়ে অনেকে আবার লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। আমরা চেষ্টা করি, তাদেরকে স্কুলে ফিরিয়ে আনতে।

চর কালকিনি ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মেহেদি হাসান লিটন বলেন, ভাঙন এ এলাকার বহু মানুষকে নি:স্ব করে দিয়েছে। অনেকে সব হারানোর পর এলাকায় থাকতে না পেরে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। কিছু মানুষ আবার নদীকেন্দ্রিক জীবিকার কারণে অস্থায়ীভাবে বাসা বেঁধে এখানে আছেন। বহু ঐতিহ্যবাহী পরিবার পথে বসে গেছে।    

চর ফলকন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দিন বলেন, দেড়শ’ বছর আগে মেঘনার বুকে জেগে ওঠে এই চর। একশ’ বছরে জনপদ সৃষ্টি হয়। এ সময়কালে যে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন সৃষ্টি হয়েছিল, তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সব হারিয়ে মানুষজন বিভিন্ন স্থানে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। ভাঙন ঠেকাতে উদ্যোগ না থাকায় ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়েছে।       
     
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com]

বাংলাদেশ সময়:  ০১২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।