ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

কারেন্ট জাল না পুড়িয়ে উৎপাদন বন্ধ করুন

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৪৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৪
কারেন্ট জাল না পুড়িয়ে উৎপাদন বন্ধ করুন ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

লক্ষ্মীপুর ও ভোলা ঘুরে এসে: কারেন্ট জাল উৎপাদন বন্ধ করুন...। নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরা প্রসঙ্গ তুলতেই জেলেদের এই দাবি।

মহাজন-দাদনদারের চাহিদা মিটিয়ে নিজের ঘরে কিছুটা নেওয়ার আশায় জেলেরা কারেন্ট জাল ব্যবহার করেন। এই জালের দাম বেশি, ব্যবহারেও আছে জটিলতা। তবুও এর ব্যবহার বাড়ছেই উপকূলের বিভিন্ন এলাকায়।

সূত্র বলছে, বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় প্রশাসনের অভিযানে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল পোড়ানো হলেও এর ব্যবহার কোনভাবেই কমছে না। প্রতি বছর ধ্বংস করা হয় লাখ লাখ টাকার কারেন্ট জাল। এরফলে নি:স্ব হয় বহু জেলে। অনেকে আবার নতুন করে দেনায় জড়িয়ে পড়ে।

জেলেসহ মাছধরার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, জাল পুড়িয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। উৎপাদন বন্ধ করতে না পারলে কারেন্ট জালের ব্যবহার বন্ধ হবে না।

লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের মতিরহাটের জেলে বজলু মাঝি বললেন, আশপাশের জেলেরা কারেন্ট জাল ব্যবহার করে বলে আমিও ব্যবহার করি। অভিযানে জাল পোড়ানো হবে, সেটাও জানা আছে। তারপরও কিছু করার নেই। পরিবার পরিজন নিয়ে টিকে থাকার জন্যেই কারেন্ট জাল নিয়ে নদীতে নামতে বাধ্য হই।

ঐতিহ্যবাহী মাছঘাট মতিরহাটের মাছের আড়তে বসে কথা বলার সময় ভিড় করেন অনেক জেলে। কারেন্ট জালের ব্যবহার, নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরা, এসব প্রসঙ্গ তুলতে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা বলেন, আমাগো প্যাডে লাথি দেওন সোজা। যারা নিষিদ্ধ জাল তৈরি করে তাদের কেউ কিছু বলতে পারে না। তারা তো প্রভাবশালী লোক। কারেন্ট জাল বানানো বন্ধ হলে তো আমরা আর কিনতে পারবো না।

দীর্ঘদিন মাছধরা পেশায় নিয়োজিত আবু বকর সিদ্দিক বলেন, জেলেদের জন্য সরকারের অনেক আইন আছে। এই আইনগুলোর বিষয়ে জেলেদের কোনো মতামত নেওয়া হয় না। জেলেদের মাছধরা, মাছ পাওয়া-না পাওয়া, বারবার দুর্যোগের মধ্যে পড়া, আর্থিক অস্বচ্ছলতা, এসব বিষয়ে খোঁজ নিতে কেউ আসে না। ধারকর্জ করে জাল কিনে নদীতে গেলাম। অভিযানে সে জাল পুড়ে ফেলা হলো। দেনার বোঝা আরও বাড়ল।

ভোলার তুলাতলীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জেলে জানালেন, নিষিদ্ধ সময়ে নদীতে জাল ফেলা, কারেন্ট জাল ব্যবহার করা, এ সবের জন্য প্রধানত দায়ী দাদনদারেরা। মাছ ধরতে গিয়ে দাদনদারের কাছে জিম্মি হয়ে থাকে জেলেরা। বিনিয়োগের টাকা তুলে আনতেই জেলেদের অন্যায়ের পথে হাঁটতে বাধ্য করে দাদনদারেরা। আর এর শিকার হয় নিরীহ জেলেরা।

ভোলার ইলিশা ঘাটের জেলে ফরিদ উদ্দিন। জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন মাছধরা পেশায়। নিজের ছেলেরাও নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। অবস্থা বদলাতে পারেনি। বাবা যেভাবে দাদনের জালে আটকা ছিলেন, একইভাবে ছেলেরাও। ফরিদ বলেন, সব সময়ই আমাদেরকে দাদনদারের কাছে বন্দি থাকতে হয়।

তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেন দানদনদারেরা। ভোলা ও লক্ষ্মীপুরের একাধিক মাছ ব্যবসায়ী বলেন, দাদনদারেরা কখনোই অবরোধকালে মাছ ধরতে বাধ্য করে না। কারেন্ট জালের ব্যবহারও তাদেরই ইচ্ছায়। তবে কারেন্ট জাল মাঠে এসে না পুড়িয়ে উৎপাদন বন্ধের দাবি করেন তার।  

জেলেদের অভিযোগ, তাদের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য নেই সরকারের কাছে। মাছধরা বন্ধ থাকার মৌসুমে জেলে পুনর্বাসনের কথা বলা হলেও সে সুবিধা জেলেদের কাছে পৌঁছায় সামান্যই। সব জেলের জন্য এই সহায়তা আসে না। আবার প্রকৃত জেলেরা সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়। তা হলে নদীতে ‘অবরোধ’ মৌসুমে জেলেরা কী খেয়ে জীবনধারণ করবে, সে বিষয়ে সরকার ভাবছে না।          

ভোলা ও লক্ষ্মীপুরে যেসব জেলেদের সঙ্গে আলাপ হলো, এদের অধিকাংশই বলেছেন নদীতে ‘অবরোধ’ মৌসুমে তারা পুনর্বাসন সহায়তা পায়নি। ওই সময়ে তারা অতিকষ্টে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কারও অভিযোগ, চেয়ারম্যান-মেম্বরের নিজস্ব লোকেরা এই সহায়তা পায়। আবার কেউ বলেছেন, অপ্রতূল বরাদ্দের কথা। যেখানে জেলে থাকে ৫০০, সেখানে বরাদ্দ আসে মাত্র ৫০ জনের জন্য।

কমলনগরের কালকিনি ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বর ও মতিরহাটের মাছ ব্যবসায়ী মেহেদি হাসান লিটন বলেন, পুনর্বাসনে যে বরাদ্দ আসে তা নামেমাত্র। এই বরাদ্দ দিয়ে আসলে জেলেদের পুনর্বাসন করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাহলে প্রশ্ন আসে মাছধরা বন্ধ সময়ে এই জেলেরা কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে।  

তিনি বলেন, মাছধরা বন্ধ সময়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক জেলে চার মাস ধরে চাল সহায়তা পায়। প্রত্যেককে প্রতিমাসে ৪০ কেজি করে চাল দেয়া হয়। কালকিনি ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডে ৩২৭জন কার্ডধারী জেলে রয়েছে। কিন্তু সহায়তা পেয়েছে মাত্র ৮৫জন জেলে। তাহলে বাকি জেলেরা এ সময়ে কী কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করবে।

ইলিশের বংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যে মা-ইলিশ ধরা থেকে বিরত থাকতে আপত্তি নেই জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীদের। তবে তারা যুক্তি দেখিয়েছেন এভাবে, তিন ভাইয়ের একটি পুকুর। এক ভাই মাছ ধরা থেকে বিরত থাকল। অপর দুই ভাই মাছ ধরে নিয়ে গেল। তাতে কী মাছের বংশ বাড়বে? একই বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে নির্দিষ্ট সময়ে মা-ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও ভারত ও মায়ানমারে দেদারছে ইলিশ শিকার অব্যাহত থাকে। এজন্য ইলিশ রক্ষায় তিন দেশের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীদের।

জেলেদেরকে নদীর কিনারে রেখেই পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণের সুপারিশ রাখলেন কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আব্দুল আওয়াল। বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, সরকার জেলেদেরও পুনর্বাসনে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর পরিসর আরও বাড়াতে হবে। মাছধরা নিষিদ্ধ সময়ে সব জেলে যাতে সহায়তা পেতে পারে, সে উদ্যোগ নিতে হবে। নদীকেন্দ্রিক মানুষদের জন্য নদীর তীরেই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।       

তিনি বলেন, কারেন্ট জালের উৎপাদন বন্ধ করার বিষয়টি আদালতের কাছে। নিস্পত্তি হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
   
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]

বাংলাদেশ সময়: ০৩৪৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।