ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

জীবনযুদ্ধে পরাজিত মানুষের দল ভারি

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৫
জীবনযুদ্ধে পরাজিত মানুষের দল ভারি ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢালচর (মনপুরা, ভোলা) ঘুরে এসে: কখনো প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ, কখনো দস্যুদের সঙ্গে। আবার কখনো নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ।

সব সমস্যা মোকাবেলার পর তিনবেলা খেয়ে বেঁচে থাকার প্রয়োজনটা বড় হয়ে দেখা দেয়। আর তাই বহুমুখী প্রতিবন্ধকার মুখে পড়তে হয় প্রায় সারাটা মৌসুম।

ছোটবেলা থেকেই এক একটা মানুষের জীবন এগোয় সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। তবুও জীবনের পড়ন্ত বেলায় হিসেব মেলে না। জীবন খাতার বড় স্থান জুড়ে থাকে পরাজয়ের গ্লানি।

দ্বীপ জেলা ভোলার মনপুরা উপজেলার ঢালচরের প্রবীণ বাসিন্দারা এভাবেই না পাওয়ার বেদনা নিয়ে মৃত্যুদিন গুনছেন। এই প্রান্তিক জনপদে টিকে থাকার জন্য, এক টুকরো আশ্রয় পাওয়ার জন্যে, তিনবেলা খাবার জোটানোর জন্য কতই না চেষ্টা করেছেন তারা। নিজেদের জীবনটা যুদ্ধে কেটেছে; কিন্তু পরের প্রজন্ম আদৌ এই দ্বীপে টিকে থাকতে পারবে কীনা, সেই দুশ্চিন্তা এই প্রবীণ নাগরিকদের।

হিসেবের খাতা মিলছে না। তাই হিসেবের খাতা বন্ধ। সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা ছাড়া এদের যেন আর কিছুই করার নেই। কেউ মসজিদে পড়ে থাকেন দিনভর। কেউবা লাঠি ভর দিয়ে এপাড়া ও পাড়ায় ঘুরেই সময় কাটিয়ে দেন। আবার কেউবা শেষ বয়সেও খাটুনির কাজে।

ঢালচরের বহু পুরনো বাসিন্দা শামসুল হক। ডাক নাম ধনু মিয়া। ৯০ বছরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বয়স। শরীর ন্যূয়ে পড়েছে বয়সের ভারে। চোখে ঝাপসা দেখেন। ছোটবেলা থেকে এই চরের বসবাস করছেন তিনি। ঝড়-ঝাপটার ভেতর দিয়ে কেটেছে জীবনের এতটা সময়। শেষ জীবনে অবশিষ্ট নেই আর। পরের প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে পারবেন না কিছুই।

পুরনো দিনের স্মৃতি মনে করে ধনু মিয়া বলছিলেন, সত্তরের ঝড়ে এই চরে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। মাত্র ৫টি ঘর ছাড়া সব বাড়িঘর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে ঝড় এলে এখানকার মানুষের মনে ভয়-আতংক বাড়ে। অবস্থার যে বিশেষ কোন উন্নতি হয়েছে, তেমনটা মনে হল না ধনু মিয়ার কথায়। তিনি বলেন, আগেও এই দ্বীপের মানুষ সিগন্যাল পেত না, এখনও পায় না। তবে মোবাইল থাকায় কিছুটা সুবিধা হয়েছে।

ঝড়ের মৌসুম এলেই এখানকার মানুষ আতংকে থাকে, জানালেন ধনু মিয়া। তিনি বলেন, বর্ষাকালে একদিকে জোয়ারের পানির চাপ, অন্যদিকে ঝড়ের তাণ্ডবে চরবাসীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। বড় কোন দুর্যোগে এখানকার মানুষের নিরাপদে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। সে কারণে এবারের দুর্যোগের মৌসুমেও ধনু মিয়ার মত চরের বহু মানুষের চিন্তার শেষ নেই।

নিজের জীবনের জীবিকার সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে ধনু মিয়া জানালেন, বাপ-দাদার বাড়ি ছিল মনপুরার আন্দিরপাড় গ্রামে। সেই ভিটে নদীভাঙণে হারানোর পর এখানে আশ্রয় মেলে। ঢালচরে এসে ৬-৭ বছর বয়স থেকে ধনু মিয়া অন্যের বাড়িতে যোগালির কাজ শুরু করেন। বয়স একটু বাড়লে ১০-১২ বছর বয়সে শুরু করেন বাথানির কাজ (মহিষের রাখাল)। এরপর মালামাল বহনকারী ট্রলারে শ্রমিকের কাজ নেন। সেখান থেকে অন্যের ট্রলারে মাছ ধরার সুযোগ মেলে। দীর্ঘ জীবনে বার বার কাজের ধরণ বদলালেও প্রায় সারাটা জীবনই তাকে দেনার বোঝা টানতে হয়েছে।

শেষ বয়সে ধনু মিয়ার সম্বল ৪ একর ৪ শতাংশ জমি। চরের ভূস্বামী কামাল উদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে জমিটুকু কিনে বসতি গড়েছেন। বাকি জমিতে চাষাবাদ করেন। তবে জমির পুরো মালিকানা পাননি এখনও। নিজের তিন ছেলে আর চার মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। ছেলেরা আলাদা থাকে। কিন্তু ধনু মিয়ার জীবনের সংগ্রামটা এখনও থামেনি।

ধনু মিয়ার ঠিক সমসাময়িক আরেক জন মজুরুল্লাহ মাঝি। ভর দুপরে ঢালচরের মসজিদের সামনের ছায়ায় ধনু মিয়ার পাশে বসেই বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আলাপের শুরুতে এক কথায় বলে ফেললেন, লেখাপড়া ছাড়া জীবনে সবই করেছি। ছোটবেলা থেকে জীবনের সংগ্রামটা এতটাই কঠিন ছিল, লেখাপড়ার সুযোগ কখনোই আসেনি। জীবনের পড়ন্ত বেলায় তার উপলব্ধি, লেখাপড়াটা খুবই প্রয়োজন ছিল।

মজুরুল্লাহ মাঝি জানালেন, নদীভাঙণে সব হারানোর পর এখানে এসে এক টুকরো জমি নিয়ে বসতি গড়তে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে। চরে বিবাদমান দু’পক্ষের গোলাগুলিতে গুলির আঘাতে আহত হয়েছেন কয়েকবার। কামাল উদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে ৬ একর ৫০ শতাংশ জমি বন্দোবস্ত নিয়েছেন। বসতি বানানোর পর বাকি জমিটুকু আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

ধনু মিয়া, মজুরুল্লাহ, আবদুল বারেক, শফিকুলসহ আরও অনেক প্রবীণ ব্যক্তি রয়েছেন ঢালচরে। জীবনের শেষ বেলায় এসেও তাদের জীবন স্থিতিশীল হয়নি। জমি নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামার ভয়টা বাড়ে ধানকাটা মৌসুমে। চরের বাসিন্দারা একটি মাত্র ফসল আমন ফলিয়ে বছরের কিছুটা খাদ্য মজুদের চেষ্টা করলেও সেখানে হামলা আসে। লুটেরার দল সব ধান কেড়ে নেয়। এ কারণে ধানকাটা মৌসুমে ভয়ের জনপদে পরিণত হয় চর।

চরের আমন ধান উঠে যাওয়ার পর কাজের অভাব দেখা দেয় ঢালচরে। অনেকে তখন কাজের সন্ধানে শহরে ছোটে। কিন্তু বর্ষায় মাছধরা মৌসুম হওয়ায় শহরে যাওয়া মানুষগুলো আবার গ্রামে ফেরে। মালিকের ট্রলারে মাছ ধরতে সমুদ্রে ছোটেন তারা। কিন্তু এই মৌসুমটাই হচ্ছে দস্যুদের উৎপাতের মৌসুম। চরের অধিকাংশ মানুষ বর্ষায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করলেও তাদের নিরাপত্তায় কোন ব্যবস্থা নেই।

এভাবেই জীবন এগোয় উপকূলের প্রান্তিকে। শেষ বয়সে হিসেবের খাতা মেলে না। একে একে জীবনযুদ্ধে পরাজিত মানুষের দল ভারি হয়। শূন্য হাতে প্রস্থান ঘটে দ্বীপের অগ্রজ নাগরিকদের।

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়:  ri_montu@yahoo.com ]

বাংলাদেশ সময়: ০২৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৫
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।