ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

কুয়াকাটা উপাখ্যান-১

সৈকত সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৪৫ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০১৫
সৈকত সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সমুদ্রের নোনা জলের ঝাপটায় অপরূপ সৌন্দর্য্য নিয়ে জেগে আছে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা। বিকাশের ধারায় হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছে এই পর্যটন কেন্দ্র।

অনেক সম্ভাবনা, অনেক স্বপ্ন। এখানকার সৈকতের দীর্ঘ বেলাভূমিতে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের আকর্ষন দেশজোড়া। দলে দলে পর্যটকেরা ছুটে আসেন এই বেলাভূমিতে। তবুও কোথায় যেন থেকে যায় একের পর এক সংকট। জটিলতার অবসান হয়না কিছুতেই। সংকটের ভেতর দিয়েই ডানা মেলছে কুয়াকাটা। তারপরও প্রতিটি নতুন ভোরে নতুন আশাবাদ। এই বুঝি কুয়াকাটা ফিরে পেল প্রাণ। এইসব নিয়ে কুয়াকাটা উপাখ্যান শিরোনামে বাংলানিউজের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ পড়ুন প্রথম পর্ব

উপকূলের বিপন্ন জনপদ ঘুরে : এককালে জঙ্গলে পরিপূর্ন ভয়ের জনপদ কুয়াকাটা এখন আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। এখানে রয়েছে প্রায় আঠারো কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকত। এই সৈকত প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের ভিড়ে মুখরিত হলেও রক্ষণাবেক্ষণ নেই। সৈকত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। ভাঙছে তীর। ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সৈকত জুড়ে। সৈকতে পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট মাছ আর শুটকি পল্লীর উৎকট গন্ধ এখন পর্যটকদের সবচেয়ে বিরক্তির কারণ। এ যেন অভিভাবকহীন এক পর্যটন। সম্ভাবনা বিকাশে নেই কোন ধরণের পদক্ষেপ।  

পড়ন্ত বেলায় পশ্চিম আকাশে তেজ কমে যাওয়া সূর্যটা সৈকতের প্রান্ত জুড়ে ছড়িয়ে দেয় রক্তবর্ণ আভা। ভেজা বালুতে পর্যটকদের পায়ের ছাপ আর ছড়িয়ে থাকা শামুক-ঝিনুক যেন এক ভিন্নমাত্রা যোগ করে। জীবিকার প্রয়োজনে সমুদ্রগামী জেলেরা তখন হয়তো ঘরে ফেরে; কিন্তু গোধুলির আবছা আলো পর্যটকদের তখন নিয়ে যায় ভিন্ন আবেশে। উষালগ্নে সৈকতে আরেক হই-হুল্লোড় ছড়িয়ে পড়ে। ভোরে সমুদ্র ¯œানটা অনেকের কাছে যেন পূণ্যতা লাভের সামিল। সমুদ্রের পানিতে সব ধুয়ে মুছে মানুষগুলো ফিরে যায় আপন ঠিকানায়।

এতটা উৎসবমূখর পরিবেশের মাঝেও শুধুমাত্র অব্যবস্থাপনার কারণে পর্যটকদের চাহিদা পুরোপুরি মেটাতে পারছে না কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। সৈকতের বেলাভূমিতে পচা মাছের উৎকট গন্ধে পর্যটকেরা নির্বিঘেœ ঘোরাফেরা করতে পারছেন না। আছে আরও অনেক সমস্যা। এতটুকু নির্মল বাতাসে স্বস্থির নি:শ্বাস ফেলতে আসা মানুষগুলো যেন আরেক অস্বস্থির মধ্যে ডুবে যান এখানে এসে।
              
পড়ন্ত বেলায় সৈকতেই আলাপ রাজধানী ঢাকা থেকে আসা পর্যটক জাকির হোসেনের সঙ্গে। বললেন, এখানে এসে আমরা নির্বিঘেœ বেড়াতে পারছি না। সৈকতে উঠানামার ভালো ব্যবস্থা নেই। চারিদিকে পড়ে আছে ময়লা আবর্জনা। মাছের গন্ধ তো আছেই। দেখে মনে হয় কুয়াকাটা যেন অভিভাবকহীন। অথচ এই পর্যটন কেন্দ্রের রয়েছে অনেক সম্ভাবনা। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সে সম্ভাবনার বিকাশ ঘটানো সম্ভব।  
 
সরেজমিন ঘুরে কুয়াকাটা সৈকতের চরম অব্যবস্থাপনা চোখে পড়ে। সৈকতের জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র দু’শ গজ পশ্চিমে কারেন্ট জালে শিকার করা মাছ। জালে আটকা পড়ে মনকে মন মাছ। সেই মাছসহ জাল আর ডিঙি নৌকা উঠে যায় ষেকতে। নারী-পুরুষ আর শিশুরা মিলে জাল থেকে মাছ ছড়ানোর কাজে লেগে যায়। কিন্তু জালে বেশি পেচিয়ে থাকা মাছগুলো আর ছড়ানো হয় না। ওই মাছ জালসহ থেকে যায় সৈকতে। জালের মাছগুলো কাক-কুকুড়ের খাবারে পরিণত হয়। অন্যদিকে ছড়ায় গন্ধ। পর্যটকেরা চাইলেও এর আশপাশে বেড়াতে পারেন না।
 
শুধু মাছ নয়, জেলেদের জালে আটকা পড়া ফেলনা জলজ প্রাণী সমুদ্র সেকতেই ফেলে রাখা হচ্ছে। এছাড়া সমুদ্রের ঢেউয়ে কিছু জলজ প্রাণী সৈকতে উঠে যাচ্ছে। এগুলো অপসারণের কোন ধরণের উদ্যোগ নেয়া হয় না। ফলে এগুলো পর্যটকদের নির্বিঘেœ বেড়াতে বিঘœ সৃষ্টি করে। এছাড়া কুয়াকাটায় নিত্য ব্যবহার্য্য বর্জ্যরে একটি বড় অংশ সৈকতের এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকছে।

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে বিভিন্ন ধরণের স্থাপনা নির্মিত হলেও কুয়াকাটার কোন প্রতীকী স্থাপনা এখনও এখানে পড়ে ওঠেনি। এমন কোন স্থাপনা নেই, যা দেখলে বোঝা যাবে এটা কুয়াকাটা। সৈকতের কোন গাইডলাইন বোর্ডও স্থাপিত হয়নি আজ পর্যন্ত। বেড়িবাঁধ থেকে সৈকতের দিকে চলে গেছে পিচঢালা সড়ক। কিন্তু সৈকত প্রান্তে এ সড়কটি ভাঙণের শিকার। সৈকতে উঠানামার জন্য পাশ দিয়ে পথ বানানো হয়েছে। আলো কমে গেলে এ পথে উঠানামা অত্যন্ত কষ্টকর।   
 
অভিযোগ রয়েছে, কুয়াকাটা সৈকতের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি কিংবা কুয়াকাটা পৌর কর্তৃপক্ষ এসব সমস্যা নিরসনের কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না। ফলে বহু আকাংখা নিয়ে এখানে বেড়াতে আসা পর্যটক-দর্শনার্থীর ভোগান্তির শেষ নেই।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, পরিচ্ছন্ন সৈকত হিসাবে কুয়াকাটার আলাদা সুনাম রয়েছে। কিন্তু সে সুনাম হারিয়ে যেতে বসেছে। সরকারি প্রশাসন, পৌর পরিষদ কিংবা কুয়াকাটা বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির কোন ভুমিকা নেই। ইতোপুর্বে ট্যুরিষ্ট বোট মালিক সমিতি স্থানীয় লোকজন নিয়ে সৈকতে ফেলা ডাবের খোসা, বিভিন্ন ধরণের পলিথিন অপসারণের উদ্যোগ নিলেও তা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।

কুয়াকাটা পৌর প্রশাসক ও কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, অবশ্যই এসব যারা করছে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব কুয়াকাটা পর্যটন হলিডে হোমস এন্ড মোটেলস-এর ম্যানেজার মো. আজহারুল ইসলামের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারলেন না। এ বিষয়ে বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

কুয়াকাটা হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ জানান, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ব্যবস্থাপনায় সমস্যা রয়েছে। এই সমস্যা সমাধানে তারা উদ্যোগী ভূমিকা নেবেন।

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]

বাংলাদেশ সময়: ০১২৭ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০১৫
আরআইএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।