ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলের জেলে জীবন-৩

গভীর সমুদ্রে মেলে না প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস

সুমন সিকদার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০২ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০১৫
গভীর সমুদ্রে মেলে না প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও পিরোজপুরসহ উপকূলীয় জেলেদের জীবিকা চলে বঙ্গোপসাগরে ইলিশ শিকার করে। উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা এসব জেলের দুর্দশার তাই অন্ত নেই।

একদিকে সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই, আরেক দিকে দস্যুদের উৎপাত। তারওপর রযেছে দাদনের নীপিড়ন। প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত উপকূলের জেলে পরিবারগুলোর ঋণের বোঝাতো বেড়েই চলেছে। তাদের অন্তহীন দুর্দশার চিত্র নিয়ে বরগুনা করেসপন্ডেন্ট সুমন সিকদার এর  ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব।

উপকূলের জেলে পল্লী ঘুরে:  গভীর সমুদ্রে জেলেদের নৌকা বা ট্রলারে কোনো রেডিও দেওয়া হয় না। পাওয়া যায় না  মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক। সম্প্রতি অগভীর সমুদ্রে টেলিটকের নেটওয়ার্ক কিছুটা পাওয়া গেলেও গভীর সমুদ্রের তা পাওয়া যায় না। এতে জেলেরা সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

ফলে মৎস্য শিকারে ব্যস্ত জেলেদের কাছে আবহাওয়ার আগাম পূর্বাভাস পৌঁছায় না। এতে অনেক সময়ই তাদের ওপর নেমে আসে প্রকৃতির ভয়ঙ্কর সব বিপদ। যেখান থেকে বেঁচে ফেরা নির্ভর করে ভাগ্যের ওপর। জেলেদের উপর না বলেই নেমে আসে প্রকৃতির বিপদ।

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে সমুদ্রের কূল ঘেঁষা পদ্মা গ্রাম। জেলে পল্লীর পাশাপাশি ইলিশ বেচাকেনার জন্য সেখানে গড়ে উঠেছে একটি মিনি মার্কেট। এখানকার চরে বসত গেঁড়েছে শত শত জেলে পরিবার। ২০০৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বঙ্গোপসগারে যে ঝড় হয়েছিল তাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন এই জেলে পল্লীর ১৩ জন। সেই বিভীষিকাময় রাতের স্মৃতি এখনো তাড়া করে ফেরে এখানকার জেলেদের মধ্যে। শুধু ২০০৬ সালেই নয়- সিডর, আইলায় প্রাণ হারিয়েছেন উপকূলের অনেক জেলে।

২০০৭ সালে প্রলয়ঙ্করী সিডরে সমুদ্রে মাছ শিকার করতে যাওয়া বরগুনার চরলাঠিমারা গ্রামের ১৭ জেলে আজও নিখোঁজ রয়েছেন। তারা বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন জানেন না স্বজনরা।

বরগুনা পাথরঘাটা উপজেলার পশ্চিম হারিটানা গ্রামের জেলে মো. মাহবুব প্রায় ২০ বছর ধরে সমুদ্রে মৎস্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। মৌসুম এলেই ট্রলার নিয়ে সমুদ্র যাত্রা তার। কিন্তু কোনোদিন মহাজন তাদের নৌকায় সতর্কতার জন্য রেডিও দেননি।

একবার সামুদ্রিক ঝড়ে তার ট্রলারসহ আরো পাঁচ জেলেকে নিয়ে উঠেছিল পার্শ্ববর্তী দেশে ভারতের কোনো এক স্থানে। দীর্ঘ দুই মাস পর সেখান থেকে ফিরে আসেন তারা।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, রাত আর দিন নাই। যখন সাগরে যাই তখন থেকেই আতঙ্কে থাকি- এই বুঝি বিপদ এলো। বিপদ এলে কিছুই করার থাকে না।

বরগুনা সদর উপজেলার মাঝের চরের জেলে সালাম মাঝাই বাংলানিউজকে বলেন, জোয়ার ভাটার ওপর নির্ভর করে জেলেদের সমুদ্রে যেতে হয়। অনেক সময় জেলেরা মাছের সন্ধানে গভীর সমুদ্রে এমন এমন স্থানে যান যেখানে কোনো নেটওয়ার্কই কাজ করে না। তাই গভীর সমুদ্রে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় এমন ব্যবস্থা করা দরকার। যাতে জেলেরা ঝড়ের আগাম বার্তা পেতে পারেন।

জেলেদের সমুদ্রে রেডিও না দেওয়ার কথা অস্বীকার করে বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতি সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, জেলেদের ট্রলারে রেডিও দেওয়া হয়। কিন্তু রেডিওতে সিগন্যাল পাওয়া যায় না, তাই জেলেরাই রেডিও বহন করতে চান না। তার চেয়ে মোবাইল ফোনে অনেক বেশি দূর পর্যন্ত নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। তাই রেডিওর চেয়ে মোবাইল ফোনই বেশি ব্যবহার করতে চান জেলেরা। কিন্তু গভীর সমুদ্রে মোবাইল ফোনেও নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না।

এ বিষয়ে পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রিপন বাংলানিউজকে বলেন, সব ট্রলারে যদি ওয়ারলেস দেওয়া হয় তাহলে দ্রুত তাদের কাছে যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর পৌঁছানো সম্ভব।

তিনি আরো বলেন, আমি সরকারের কাছে আবেদন করবো যাতে সরকার জেলেদের জন্য ওয়ারলেসের ব্যবস্থা করে।

এ বিষয়ে বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বঙ্কিম চন্দ্র বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, মৎস্য বিভাগ জেলেদের রেডিও ব্যবহারে সচেতন করছে। এছাড়া গভীর সমুদ্রে নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য ভেসেল ট্র্যাকিং অ্যান্ড মনিটরিং সিস্টেমের আওতায় চট্টগ্রাম ও খুলনায় টাওয়ার নির্মাণের কাজ চলছে। এ কাজ সম্পন্ন হলে জেলেরা উপকৃত হবেন।

বাংলাদেশ সময়: ০২০২ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০১৫
এসআই/জেডএম

** দস্যুদের কার্ডেও নেই জীবনের নিশ্চয়তা
** দস্যু ভয় তবু যেতে হয়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।