ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

মরেছে শালতা, মারছে জেলে

তপন চক্রবর্তী, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৬
মরেছে শালতা, মারছে জেলে ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

তালা (সাতক্ষীরা): যৌবনে এ নদীই নিবারণ করতো লাখো মানুষের তৃষ্ণা ও ক্ষুধা। এ নদীর সুখ-দুঃখের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন তীরের হাজারো জেলে পরিবারের সদস্যরা।



একসময় নদীর রমরমা যৌবন এনে দিয়েছিল এসব জেলেপল্লীতে সুখের ছোয়া, সমৃদ্ধির শিহরণ। এখন অনেকটাই মরতে বসেছে সাতক্ষীরার শালতা নদী। সেইসঙ্গে মারছে তার ওপর ভর করে চলা জেলেপল্লীর মানুষদের।

সম্প্রতি তালা উপজেলার শালতা নদীর আশপাশ ঘুরে দেখা যায়, দিন যতো যাচ্ছে ততোই মরে যাচ্ছে শালতা। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে নদী। সেখানে এখন ধু ধু বিরানভূমি, বালুচর। এমনকি, শুধু বর্ষায় পূর্বের রূপ ফিরে পাওয়ার চেষ্টারত এ নদী তালা উপজেলার কাঞ্চননগরের ঘ্যাংরাইল নদী থেকে উজানের কাঠবুনিয়া পর্যন্ত এলাকায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

প্রাণ হারিয়ে ফেলা শালতার আসন্ন মৃত্যুতে বেকার হয়ে পড়েছেন জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন। শালতায় পানি না থাকায় জেলেরা ‍এখন অলস ও বেকার সময় কাটাচ্ছেন।

কেউ কেউ খুঁজছেন বিকল্প কর্মসংস্থান। অনেকেই চলে গেছেন নানান পেশায়। বাকিদের অধিকাংশ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন বিভিন্ন মৎস্য ঘেরে শ্রমিক হিসেবে।

ফলে নিত্য অভাব-অনটন লেগেই আছে তালার জেলেপল্লীতে। স্বাভাবিকভাবে এখন সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে জেলেদের। অর্ধাহারে দিন কাটছে অনেক পরিবারের।

তালা উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে জেয়ালানলতা গ্রাম। এই গ্রামের প্রায় আটশ জেলে পরিবারের বসবাস। এসব পরিবারের সদস্য সংখ্যা অন্তত চার হাজার। কিন্তু শালতা নদী শুকিয়ে ও ভরাট হয়ে মরা সরু খাল ও বিরানভূমিতে পরিণত হওয়ায় বিপাকে রয়েছেন জেলেরা।

শালতা নদীতীরে তালা উপজেলার ‘চাড়িভাঙ্গা’ গেট। এ গেটের পাশেই পরিবারের সঙ্গে বাস করেন আনোয়ারা বেগম (৬৫)।

এই বৃদ্ধা বাংলানিউজকে বলেন, তিনি এক ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে ৩০ বছর ধরে এই ওয়াপদার পাশে বসবাস করছেন। স্বামী খোদাবক্স বিশ্বাস শালতা নদীতে খেয়া পারাপার ও মাছ শিকার করতেন। সাত বছর আগে স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। নদীও পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। এখন তীরে পড়ে আছে তার স্বামীর ব্যবহৃত নৌকাটি।

চাড়িভাঙ্গা গেটের উপর দোকান সাজিয়ে বসা মুদি দোকানি আকবর বিশ্বাস জানান, নদী মরে যাওয়ায় গ্রামের অধিকাংশ জেলে পরিবারের লোকজন বর্তমানে জীবিকার সন্ধানে চট্টগ্রাম, বরিশালসহ বিভিন্ন নদীকেন্দ্রিক এলাকায় মাছ ধরতে যাচ্ছেন। তিন-চার মাস পরপর বাড়ি আসেন তারা। অনেকে আবার  বিভিন্ন শহরে রিকশা চালান। নদী বেঁচে না থাকায় এলাকার মানুষও এখন ভালোভাবে বেঁচে নেই।

এই গ্রামের বাসিন্দা আনার আলি বিশ্বাস বলেন, ‘হাতে কাজ নেই। কি খাব, কোথায় যাব? নদী থাকলে আমাগে (আমাদের) পেটে ভাত যেত। এখন বেকার বাড়ি বসে আছি। ’

গ্রামের আরেক বাসিন্দা মোহাম্মদ বিশ্বাস বলেন, ‘আগে অনেক বড় নদী ছিল শালতা। এখন দেখলে মনেই হবে না যে, এখানে নদী ছিল। আগে নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাতাম। এখন অন্যের ঘেরে শ্রমিক হিসেবে মাছ ধরে সংসার চালাতে হয়। কিন্তু ওই টাকায় সংসার চলে না। ’

জেলে নুরু আলী বিশ্বাস আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের পেশা টিকিয়ে রাখতে এখন রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। নদী বেঁচে থাকলে আমাদের এ অবস্থা হতো না।

সাতক্ষীরার বেসরকারি সংস্থা ‘উত্তরণ’র একটি জরিপে দেখা যায়, সাতক্ষীরার তালা উপজেলা এবং খুলনার পাইকগাছা ও ডুমুরিয়া উপজেলার সীমানা বিভাজন করে মাগুরখালী ইউনিয়নের কাঞ্চননগরের ঘ্যাংরাইল নদীতে মিলিত হয়েছে শালতা। শালতা নদী দৈর্ঘ্যে প্রায় ৪০ কিলোমিটার। নদী অববাহিকায় নয়টি ইউনিয়নে গ্রাম রয়েছে ৯৪টি। সে হিসেবে নদীতীরে আট হাজার জেলে পরিবারে অন্তত দেড় লক্ষাধিক মানুষের বসবাস।

জেয়ালা নলতা মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, শালতাসহ আশপাশের নদীগুলো সব ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীতে মাছ ধরে যাদের সংসার চলতো, তারা এখন বাড়িতে বসা। অনেকে পেশা পরিবর্তন করেছেন।

তালা উপজেলা পানি কমিটির সাধারণ সম্পাদক মীর জিল্লুর রহমান জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। জোয়ার-ভাটা না থাকার কারণে পলি পড়ে শালতাও ভরাট হয়ে গেছে। জরুরিভাবে শালতা নদী খনন না করলে এলাকার জেলেরা ও জীব-বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।
 
স্থানীয় খলিলনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান প্রণব ঘোষ বাবলু বলেন, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। সরকারি জলাশয়গুলো প্রভাবশালীদের দখলে। শালতা নদীই ছিল তাদের আয়ের একমাত্র উৎস। কিন্তু শালতা নদীও ভরাট হয়ে গেছে। যে কারণে শালতাপাড়ের জেলেরা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।

তালা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ঘোষ সনৎ কুমার জানান, নদী মরে যাওয়ায় এলাকার অনেকেই জীবিকার সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় চলে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে তালা উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. হাদিউজ্জামান জানান, স্রোত না থাকায় নদ-নদীগুলো মরে যাচ্ছে। পলি পড়ে নদী ভরাট হয়ে গেছে।
যারা উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারা এখন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১২২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৬
এসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।