ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

আজো আঁতকে ওঠেন উপকূলবাসী

ছোটন সাহা, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৭
আজো আঁতকে ওঠেন উপকূলবাসী আজো আতঁকে ওঠেন পুরো উপকূলের মানুষ। ছবি: বাংলানিউজ

ভোলা: ভয়াল ১২ নভেম্বরের ৪৭তম বর্ষপূর্তি রোববার। ১৯৭০ সালের এদিনে আঘাত হানা মহা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারান উপকূলের প্রায় ১০ লাখ মানুষ।

তাদের জীবনে মহাদুর্যোগ নেমে আসা ভয়াল সেই দিনটির কথা মনে করে আজো আতঁকে ওঠেন পুরো উপকূলের মানুষ। স্বজনহারা মানুষেরা ভুলতে পারেননি সেই দুর্বিষহ স্মৃতি।

আর ক্ষতচিহ্নের বর্ণনায় শিউরে ওঠেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

প্রবীণেরা জানান, সাত উপজেলা নিয়ে পুরো দ্বীপজেলা ভোলাও ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয় সেদিন রাতে। পরদিন ভোরে জলোচ্ছ্বাসের ১০/১২ ফুট পানিতে নিমিষেই তলিয়ে যায় উপকূলীয় চরাঞ্চলের বাড়ি-ঘর, সোনালি ফসলের মাঠ, উঠানে স্তূপাকার ও গোলা ভরা পাকা ধান। স্রোতের তোড়ে হাজার হাজার মানুষ ও কয়েক লাখ গরু-মহিষ ভেসে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যাপক ফসলি জমি, প্রাণী ও বনজসম্পদ। বিস্তীর্ণ উপকূলীয় জনপদ পরিণত হয় বিরাণভূমিতে।

শুধু ভোলা জেলায়ই সেদিন মারা যান লক্ষাধিক মানুষ। নদীতে যেমন ভাসছিল, ঠিক তেমনি গাছে গাছেও ঝুলেছিলো মানুষের মরদেহ। তীব্র লড়াই করে কেউ কেউ বেঁচে গেলেও স্বজনদের হারিয়েছেন চিরতরে। বেশিরভাগ পরিবারেরই কেউ বেঁচে ছিলেন না।

দৌলতখান উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের তাজউদ্দিন পাটোয়ারি বাড়িতেই নিহত হন একই পরিবারের ৫ জনসহ ৫৫ জন।

একের পর এক দুর্যোগ আঘাত হানলেও আজো  নির্মিত হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ ও আশ্রয়কেন্দ্র।  ছবি: বাংলানিউজ৩ মেয়ে ও ২ বোন হারানো বাড়িটির নুরুল ইসলামের স্ত্রী সাহিদা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ‘সেই বাড়ির ২০টি ঘরে ছিল ২০০ মানুষের বসবাস। আমিও ছিলাম তাদের সঙ্গে। চোখের সামনেই মারা গেল ৫৫ জন। কারো মরদেহই খুঁজে পাওয়া যায়নি। নিজে করার পাশাপাশি দেখলাম অন্যদের বেঁচে থাকার লড়াই আর স্বজনহারাদের আহাজারিও’।

কান্নাজড়িত ও আঁতকে ওঠা কণ্ঠে সাহিদা বলেন, ‘সেই ঝড়ে বড় মেয়ে সাহানুর, মেজো মেয়ে তাছনুর ও ছোট মেয়ে মিনা আর দুই বোন রোকেয়া ও রাবেয়া কোথায় যে চলে গেল! আজো তাদের সন্ধান পাইনি। আমিও যাওয়ার পথে। জানি না তাদের দেখা পাবো কি-না?’  

স্বজনহারা মনির বলেন, ‘ঝড়ে আমার তিন বোনকে হারিয়েছি। তাদের কথা মনে করে আজো মা কাঁদেন’।

তুলাতলী এলাকার বাদশা মিয়া বলেন, ‘মেঘনা নদী দিয়ে মানুষের মরদেহ ভাসতে দেখেছি। পরিচিত কারো কারো মরদেহ উদ্ধার করতে পেরেছি। বেশিরভাগই স্রোতে ভেসে গেছে’।

মদনপুরের রহমত আলী, ছিদ্দিক ও সিরাজ উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের গ্রামের ১৮টি ঘরের ৪০ জনের মরদেহ পাওয়া যায়। একটি পরিবারের কেউই বেঁচে ছিলেন না’।

৩ মেয়ে ও ২ বোন হারানো সাহিদা বেগম আঁতকে ওঠেন আজো।  ছবি: বাংলানিউজ  প্রত্যক্ষদর্শী শাহে আলম বলেন, সেদিন দিনভর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছিল। রাতে পুরোদমে ঝড় শুরু হয়। ভোরে জলোচ্ছ্বাসে মারা যান আরও অসংখ্য মানুষ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মনপুরা, চরফ্যাশন ও লালমোহন উপজেলায়।

প্রেসক্লাবের সভাপতি প্রবীণ সাংবাদিক এম হাবিবুর রহমান বলেন, ‘জলোচ্ছ্বাসের বন্যায় দৌলতখানের চৌকিঘাটে সাপ আর মানুষকে জড়িয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি। স্নেহময়ী মা তার শিশুকে কোলে জড়িয়ে পড়েছিলেন মেঘনার পাড়ে। সোনাপুরের একটি বাগানে গাছের ডালে নারীর মরদেহ ঝুলছিল’।

‘মনপুরা, চরফ্যাশন, লালমোহন, তজুমদ্দিন ও দৌলতখানসহ পুরো জেলায় মানুষ আর গবাদিপশু বঙ্গোপসাগরের উত্তাল জলে ভেসে গেছে। জনমানুষশূন্য হয়ে পড়েছিলো এ দ্বীপজেলা’।

আরও পড়ুন: ** সেদিনের স্মৃতি এখনো কাঁদায় উপকূলবাসীকে
             ** ভয়াল ১২ নভেম্বর এলে আঁতকে উঠে উপকূল

তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও সংবাদকর্মী এম এ তাহের জানান, ভয়াল সে রাত কেটে পরদিন শুক্রবার ভোলা শহরজুড়ে ধ্বংসস্তুপ দেখা যায়। প্রায় কোমর পানি আর চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল অসংখ্য মরদেহ।

পানি ভেঙে তিনিসহ বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মোশারেফ হোসেন শাহাজানসহ আরো অনেকে বের হন ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায়। সবাই মিলে প্রায় ৩৫০ জনের মরদেহ দাফন করান।

সব সময়ই মৃত্যুঝুঁকিতে থাকেন উপকূলের মানুষ।  ছবি: বাংলানিউজউপকূলবাসীর অভিযোগ, প্রতি বছরই ঝড় আসে, অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। একের পর এক দুর্যোগ আঘাত হানলেও আজো তাদের জন্য টেকসই বেড়িবাঁধ ও আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হয়নি। ফলে এখানকার মানুষ সব সময়ই মৃত্যুঝুঁকিতে থাকেন। ঝড়-ঘূর্ণিঝড় মৌসুমে মৃত্যু তাড়িয়ে বেড়ায় তাদেরকে।

বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৭
এসআই/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।