ফেনী থেকে যাত্রা শুরু করে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর মজু চৌধুরী লঞ্চ-ফেরিঘাট হয়ে ভোলার ইলিশা ফেরিঘাটে পৌঁছে ভেবেছিলাম আর হয়তো বেশিপথ নেই কাছেই চর কুকরী মুকরী। কিন্তু ভোলায় কর্মরত সহকর্মী ছোটন সাহা জানালেন চরে যেতে আরও অনেক পথ বাকি।
এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। তাই সিদ্ধান্ত হলো রাতটা ভোলা শহরে কাটিয়ে সকালে রওনা দেওয়া যাবে। রাতটা কোনো রকমে কাটিয়ে পরদিন সকালের আলো ফোটার আগেই রওনা করেছিলাম ভোলার চর ফ্যাশন উপজেলার উদ্দেশে। সকাল ৯টায় চর ফ্যাশন পৌঁছে একটি মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা করি চর কচ্ছপিয়া ঘাটের উদ্দেশে, সেখান থেকে নৌকায় করে যেতে হয় চর কুকরীতে। বেলা সাড়ে ১০টা নাগাদ ঘাটে পৌঁছে দেখি নৌকা থেকে নামছে মানুষ। স্থানীয় একজন জানালেন বেলা ১১টা থেকে আরেকটি নৌকা চর কুকরীর উদ্দেশে ছেড়ে যাবে।
অপেক্ষা করছিলাম কখন নৌকা আসবে, বেলা সোয়া ১১টার দিকে নৌকায় উঠতে শুরু করেছে মানুষ। ইঞ্জিনচালিত নৌকাটি ভর্তি হওয়ার পর বেলা সাড়ে ১১টায় চর কচ্ছপিয়া ঘাট ছাড়ে। নৌকার আরেক যাত্রী ষাটোর্ধ্ব খলিলুর রহমান জানালেন দেড় থেকে দুই ঘণ্টায় আমরা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবো।
নৌকা চলছে আমরাও চলছি, চলতে চলতে হঠাৎ করে শরীরে আরও শীতলতা অনুভব হলো। চোখ চলে যায় নদীর পাড়ের সবুজ অরণ্যে। আঁকা-বাঁকা খাল ফেরিয়ে যখন নদীর মোহনায় চোখে পড়ে সেখানে অপার সৌন্দর্যের হাতছানি।
নদীর ঢেউ, নির্মল বাতাস, বাহারি ম্যানগ্র্যোভ বন, নদীপাড়ের সারি সারি গাছ, দৃষ্টির সীমানার পুরোটা যেন সবুজ আর সবুজ। অপরূপ প্রকৃতির সাজে সাজানো বনভূমি মনে দেখে হলো এ যেন আরেক সুন্দরবন।
নৌকা চলতে চলতে ধরা দেয় নানা দৃশ্যপট। বন থেকে কাঠ কেটে নৌকা ভর্তি করে কেউ নিয়ে যাচ্ছে, কেউবা আবার মাছ ধরছে। নদীপাড়ে রাখা গরুর পাল নিয়ে হেঁটে যায় রাখাল। হঠাৎ করে চোখ পড়ে নদীর পাড়ে, একটি বুনো মহিষ পানি পান করছে নদী থেকে। নৌকার আরেক যাত্রী খলিলুর রহমান জানালেন, এ বনে মহিষ ছাড়াও শেয়াল, হরিণসহ আরও অনেক ধরনের পশু পাখি রয়েছে।
এসব দেখতে দেখতে কখন যে আমরা কুকরী মুকরী ঘাটে এসে পড়েছি আঁচও করতে পারিনি। নৌকার ভাড়া মিটিয়ে যখন কুকরীতে পা রাখছিলাম তখন অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছিল। সবুজ দ্বীপ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি নিবিড় ভালোলাগার এক চিরসবুজ প্রশান্তি ছুয়ে যাচ্ছিল।
ঘাট থেকে মোটরসাইকেলযোগে রওনা করেছি কুকরী মুকরী বন বিভাগের রিসোর্টের উদ্দেশে। যেতে যেতে গল্প হচ্ছিল মোটরসাইকেলের চালক কবিরের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ভোলা জেলা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে অনেকটা সাগরের কোল ঘেঁষে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা এই চর কুকরী মুকরীতেই রয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য।
কথিত আছে, একসময় এই চরে শুধু কুকুর আর ইঁদুর (স্থানীয়দের কাছে যা মেকুর নামে পরিচিত) ছাড়া আর তেমন কিছুই চোখে পড়তো না। আর তাই এই চরের নামকরণ হয় কুকরী মুকরী। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে মেঘনা নদীর মোহনায় কুকরী-মুকরীর অবস্থান। চারিদিকে জলরাশি দ্বারা বেষ্টিত প্রমত্তা মেঘনার উত্তাল ঢেউয়ে পলি জমতে জমতে এ দ্বীপটির জন্ম। জানা যায়, প্রায় ৮শ’ বছরের পুরনো এই স্বপ্নের দ্বীপ কুকরী-মুকরী বর্তমানে অতি পরিচিত নাম।
মিনিট ২০ পরে আমরা পৌঁছে যায় রিসোর্টে, সেখানে ব্যাগপত্র রেখে ক্যামরা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। সহকর্মী ছোটন সাহা জানিয়েছিলেন, এখানের দর্শনীয় স্থান নারকেলবাড়িয়া, বালুর ধুম, কেওড়া বাগান, শুটকি পল্লি ও চর পাতিলা।
কুকরী মুকরী বাজারে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জেনে নিলাম আদ্যপান্ত। বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, এ চরের ইতিহাস বেশ প্রচীন। ৭শ’ বছর আগে এখানে ও মনপুরায় পর্তুগীজ জলদস্যুদের আস্তানা ছিল, কিন্তু কোন এক সময় এই চরটি পানির তলে হারিয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯১২ সালে এই চরটি আবার জেগে ওঠে। ১৯৭২ সালে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার কুকরী মুকুরী চরে বন সম্প্রসারণ অধিদফতরকে বনায়ন করার নিদের্শ দিলে ১৯৭৩ সনে বনায়ন শুরু হয়।
এছাড়া গোটা এলাকা জুড়েই চোখে পড়ে বিপুল সংখ্যক কেওড়া গাছ। মূলত বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা এসব গাছ আর আশপাশের নারিকেল গাছ, বাঁশ ও বেত বন মিলেই এখানে তৈরি হয়েছে আকর্ষণীয় ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল। বন বিভাগ ও বিভিন্ন সূত্র জানায়, ভাঙা গড়ার আবর্তে পড়ে বর্তমান কুকরী-মুকরী চরে বনায়নের পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে সংরক্ষিত বাগান ৯ হাজার ৪শ’ একর, ৬ ধারায় প্রস্তাবিত ৬ হাজার হেক্টর, বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম ২১৭ হেক্টর। বসতি ও কৃষি আবাদ আছে প্রায় ৪ হাজার ৮১০ হেক্টরে। চরের মানুষের প্রধান পেশা মাছ ধরা ও কৃষিকাজ।
বন কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম জানান, এ চরে চিত্রা হরিণ, বানর, উদবিড়াল, পাতি শিয়াল, বন্য মহিষ-গরু, বনবিড়াল, বন মোরগসহ নানা প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। বক, শঙ্খচিল, মথুরা, কাঠময়ূর, কোয়েল, গুইসাঁপ, বেজি, কচ্ছপ নানা ধরনের সাপও রয়েছে এ চরে।
বন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ সেরে বেরিয়ে পড়ি চর দর্শনে। মোটরসাইকেলে করে কিছুদূর যাওয়ার পর চালক নামিয়ে দিলেন, বললেন সামনে কেওড়া বন। বন দিয়ে হেঁটে যেতে হবে শুটকি পল্লি ও নারিকেলবাড়িয়ায়। সফর সঙ্গী দুলাল তালুকদারকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম বন দিয়ে। বনে ঢুকতেই মনে হয়েছিল যেন সুন্দরবনে ঢুকে পড়ছি। গেওয়া, গরান ও সুন্দরী গাছ এবং শ্বাসমূলীয় গাছের বন এটি। প্রায় মিনিট ২০ হাঁটার পর বন শেষ হলো। তখন বিকেল ৩টা। গহীন বন থেকে বেরিয়ে দেখি এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। শুটকি পল্লিতে ব্যস্ত সময় পার করছে জেলেরা। নদী থেকে নৌকা এনে ভিড়াচ্ছে ঘাটে। সেখান থেকে চেওয়া মাছ নামিয়ে খালি মাঠে শুটকি বানানোর জন্য শুকাতে দেওয়া হয়েছে। জেলেদের এমন ব্যস্ততা যেন কথা বলার সময়ও কারও নেই।
অনেক কষ্টে একজনের সঙ্গে কথা বলা গেল। তার কাছে জানতে চাইলাম নারকেলবাড়িয়া এবং চর পাতিলার ঠিকানা। তিনি বললেন, নদী পাড়ি দিলেই নারকেলবাড়িয়া। বিপত্তি দেখা দিল সেখানেই। সবাই তো ব্যস্ত মাছ শুকাতে কে পার করে দেবে। শেষে একজনকে রাজি করানো গেল যিনি আমাদের নদী পার করে দিলেন। নদীর ওপাড়ের রূপ আরও মুগ্ধতার। নদী পাড় যেন শুভ্রতায় মোড়ানো। কারণ সাদা বকের সমারোহ সেখানে। রয়েছে শীতের অতিথি পাখিও। অন্যপাড়ে ম্যানগ্রোভ বন। এসব দেখে যে কারোর মনে হতে পারে সুন্দরবন এসে পড়েছি।
ঢাকা থেকে আসা আকাশ নামের আরেক পর্যটক জানালেন, এ চরে বেড়ানোর জন্য শীতই যথোপযুক্ত। কুকরী-মুকরীর শীতকালের চিত্র মুগ্ধ হওয়ার মতো। বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির কলতানে মুখরিত হয়ে ওঠে এসব অঞ্চলের চারপাশ। অতিথি পাখিদের আগমনে চরাঞ্চলগুলো যেন নতুন রূপ ধারণ করে। এছাড়া এখানকার সমুদ্র সৈকতটিও বেশ পরিচ্ছন্ন ও নিরিবিলি। দেশের অন্যান্য পর্যটক কেন্দ্রগুলোর তুলনায় কুকরী-মুকরীর চিত্র কিছুটা ভিন্ন। মাইলের পর মাইল বৃক্ষরাজির বিশাল বনভূমি কুকরী-মুকরীকে সাজিয়েছে ভিন্নভাবে।
স্থানীয় জেলে আবদুল মজিদ জানালেন, চর কুকরী মুকরীর ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে একটি খাল। খালটির নাম ভাড়ানি খাল। মেঘনার বিশাল বুক থেকে বয়ে গিয়ে খালটি পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। এখানকার ধূ-ধূ বালিয়াড়ির ওপর দাঁড়ালে সাগরের শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাবে না। স্থানীয় মানুষ এ স্পটটিকে বালুর ধুম নামে ডাকে। একটু সামনে এগোলেই ঢাল চর। এরপরই বঙ্গোপসাগর। এখানে উত্তাল ঢেউয়ের আছড়ে পড়া দেখলেই মনে পড়ে যাবে কক্সবাজার কিংবা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের কথা।
এখানে বসেই সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। তবে কুকরী মুকরীর প্রধান আকর্ষণ সাগরপাড়। এখানে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত কিংবা সূর্য ডোবার দৃশ্য ভ্রমণপিপাসুদের মুগ্ধ করবে। চর কুকরী মুকরীর এ সৌন্দর্য খুব টানে পর্যটকদের। ডুবন্ত সূর্যের লাল, হলুদ, কমলা আভা সবুজরঙা চর কুকরী-মুকরীর বনে ছড়িয়ে পড়ে বনটিকে আরও মায়াবী করে তুলেছে।
যাওয়ার পথ
ঢাকা থেকে লঞ্চে সরাসরি যেতে পারবেন ভোলা জেলার চরফ্যাশনে। সেখান থেকে মোটরসাইকেল কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে চর দক্ষিণ আইচা এলাকার চর কচ্ছপিয়া ঘাটে। এরপর চর কচ্ছপিয়া ট্রলার ঘাট হয়ে আবারও ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বেশ খানিকটা জলপথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছানো যাবে চর কুকরী মুকরীতে। লক্ষ্মীপুর থেকে যেতে হলে মজু চৌধুরী লঞ্চ ও ফেরিঘাট থেকে লঞ্চ/ট্রলার/স্পিডবোটে ভোলার ইলিশা ঘাট, সেখান থেকে অটোরিকশায় ভোলা শহরে। শহরের উকিল পাড়ায় চর ফ্যাশনের বাসে করে চর ফ্যাশন গিয়ে পূর্ব নির্দেশিত পথে।
থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
এ চরে থাকার ব্যবস্থার মধ্যে চর কুকরী মুকরী বাজারের পাশে বন বিভাগের একটি রির্সোট রয়েছে। সেখানে থাকতে হলে যোগাযোগ করতে পারেন সেখানকার কেয়ারটেকার হানিফের সঙ্গে, মোবাইল ফোন নাম্বার-০১৭৩৯৯০৮০১৩।
থাকতে পারেন ইউনিয়ন পরিষদে। সেজন্য যোগাযোগ করতে হবে চেয়ারম্যান হাসেম মহাজনের সঙ্গে-০১৭১৬২২৬৮১৪।
বাজারে হানিফ নামের একটি হোটেল রয়েছে। রিসোর্ট আর ইউনিয়ন পরিষদে খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলেও এখানে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এজন্য যোগাযোগ করতে হবে ০১৯৭৫৯১১১৩৬ নাম্বারে।
এছাড়া বাবুল মাঝি নামের একজন তার বাড়িতেই পর্যটকদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। সেখানে স্বল্প খরচে থাকা যায়। তার সঙ্গে যোগাযেগ করতে পারেন ০১৭৪৫৪৩২২৩৭ নাম্বারে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৯
এসএইচডি/আরআর