পরিবেশের পক্ষে শত শত মামলা করে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পদকও। ‘পরিবেশ পদক-২০১৫’ প্রাপ্ত এই পরিবেশের ফেরিওয়ালা হচ্ছেন উচ্চ আদালতের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
সম্প্রতি দেশের পরিবেশ রক্ষায় উচ্চ আদালত ও নিজের সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেছেন বাংলানিউজের সঙ্গে।
ঝালকাঠি সদরের কীর্তিপাশা ইউনিয়নের বাউলকান্দা গ্রামে জন্ম নেওয়া এই আইনজীবী বিবেকের তাড়না থেকে পরিবেশ ও মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করছেন ২০০৪ সাল থেকে। ১৯৮৮ সালে ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে ও ১৯৯৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হন। দীর্ঘ প্রায় দুই যুগে সুপ্রিম কোর্টে ঐতিহাসিক বিভিন্ন মামলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘মানবাধিকার ও পরিবেশ রক্ষায় উচ্চ আদালতকে আইনি যুক্তি দিয়ে সন্তুষ্ট করা এতো সহজ নয়। কিভাবে সংবিধান ও আইনের ভেতরে থেকে মানবাধিকার ও পরিবেশের পক্ষে রায় নিয়ে আসতে হবে, তা শিখেছি সিনিয়র ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামের কাছ থেকে। সংবিধানের ব্যাখ্যা দিয়ে কিভাবে আবেদনের খসড়া তৈরি করতে হবে, সেটিও তার চেম্বারে কাজ করার সময় শিখেছি। তাই এখন দ্রুত যেকোনো মামলার দরখাস্ত তৈরি করতে পারি। এবং আদালতকে বুঝাতে সক্ষম হই’।
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘দীর্ঘ এ সময়ে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করতে গিয়ে আজীবন স্মরণে থাকবে ঢাকার চার নদীর মামলাটির কথা (বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ)’।
‘দখল ও দূষণ থেকে রক্ষা করতে এ চার নদীর মামলা যখন প্রথমে করা হয়, তখন বিবাদী ছিলো কেবল সরকার। কিন্তু যখন রায় হলো এবং এ রায় কার্যকর করতে গেলে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে আঘাত লাগলো। তখন তারা উচ্চ আদালতে আসা শুরু করলো। বড় বড় আইনজীবী নিয়ে মামলা লড়া শুরু করলো। আমি তাদের প্রতিপক্ষে একমাত্র আইনজীবী। হাল ছাড়িনি’।
তিনি বলেন, ‘জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বড় বড় ব্যবসায়ীদের পক্ষে এসে বললেন, সরকার লিজ দিয়েছে, তাই ব্যবসায়ীরা স্থাপনা গড়ে ব্যবসা করছেন। আইনত তাদের উচ্ছেদের সুযোগ নেই। তখনই আদালত সহায় হলেন’।
‘পরিবেশ রক্ষায় নদীর জায়গা সরকার কাউকে লিজ দিতে পারে না- আমার যুক্তিতে আদালত সন্তুষ্ট হয়ে রায় বহাল রাখলেন। পরে চার নদী থেকে সব স্থাপনা উচ্ছেদ করে সীমানা খুঁটি স্থাপন করা হয়েছে’।
তবে এসব কাজে তার প্রথম সূত্র হলো গণমাধ্যম। কোনো গণমাধ্যমে পাহাড় কাটা, নদী, খাল, পুকুর দখল ও দূষণ, অবৈধ বালু উত্তোলন, বন উজাড়, বনের মধ্যে করাত কল, কক্সবাজার, কুয়াকাটা, সেন্টমার্টিনে অবৈধ স্থাপনা, খেলার মাঠ, পার্ক ও ঐতিহাসিক স্থাপনা বেদখলের খবর নজরে এলেই মামলা করেন মনজিল মোরসেদ।
তিনি বলেন, ‘প্রথমদিকে প্রায় ৯৮ শতাংশ খবরের সত্যতা পাই। দুই শতাংশে সমস্যায় পড়েছি। এরপর গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি তাদের খবরের ওপর ভিত্তি করে উচ্চ আদালতে মামলা করা হয়। তাই তারা যেন অথেনটিক সংবাদ পরিবেশন করেন। অবশ্য এখন আর সে সমস্যায় পড়তে হয় না। সংবাদের প্রায় শতভাগই সত্যতা থাকে’।
প্রতিনিয়ত পরিবেশ নিয়ে মামলা করতে হয়। পরিবেশ রক্ষায় আদালতের আদেশে প্রায় সময় খড়গ নেমে আসতো পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের ওপর।
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘পরিবেশ অধিদফতর এক সময় বিরক্তি প্রকাশ করতো। সমালোচনা করতো। এটিকে ঝামেলা মনে করতো। কোর্টের তলবে হাজির হতে হতো। এখন পরিবর্তন হয়েছে। এখন তারাই সহায়তা করে। কিন্তু পুরোপুরি সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জনবলের অভাব ও বাজেট স্বল্পতা, অন্যদিকে প্রভাবশালী ও বিত্তশালীদের বিপরীতমূখী অবস্থান’।
তিনি বলেন, ‘পরিবর্তন হয়েছে, তা তো বোঝাই যায়। পরিবেশ অধিদফতর পদক দিয়েছে। এখন তারা পরিবেশের পক্ষে মামলা করতে গোপনে আমাকে কাগজপত্র দেয়, অনুপ্রেরণা দেয়। কিন্তু প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তাদেরকে আরও সাহসী ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে’।
পরিবেশ রক্ষায় খ্যাতি অর্জন করা এ আইনজীবীর বিড়ম্বনাও কম নয়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিনিয়ত টেলিফোন আসে বিপদে পড়া মানুষের। যদিও ব্যক্তি জীবনের ওপর এটি একটি হ্যাম্পার, তবে তিনি বিষয়টিকে এনজয় করেন।
‘একটি ভালো সাজেশন দিতে পারি। কিন্তু কার্যকরী প্রতিকার অনেক সময় দিতে পারি না’ বলে উল্লেখ করে মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘এজন্য মানসিক যন্ত্রণায় থাকি’।
এসব কাজ করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী দু’বার মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন। পাঠিয়েছে কাফনের কাপড়ও । তবে এসব হুমকিকে আমলে নিচ্ছেন না মনজিল মোরসেদ। তার মতে, হুমকি আসছে কিছু মানুষের কাছ থেকে। অধিকাংশ মানুষতো সঙ্গে আছেন। সব শ্রেণীর মানুষই তার কাজে প্রেরণা দিচ্ছেন এবং তাতে উৎসাহ পান তিনি।
ব্যক্তি জীবনে মনজিল মোরসেদ দুই সন্তানের জনক। ছেলে বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পাস করে এখন উচ্চতর শিক্ষা নিতে বিদেশে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অনার্সে অধ্যয়নরত। স্ত্রী মৎস্য অধিদফতরে কর্মরত।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৬ ঘণ্টা, জুন ০৫, ২০১৭
ইএস/এএসআর