কাশ্মীরের কথা না শোনার কোনো কারণ নেই। তবে এটুকু মোটামুটি নিশ্চিত, ক্রিকেটীয় খবরে চড়ে খোঁজ পাননি জায়গাটার।
কল্পনা করে দেখতে পারেন, বর্ণনাহীন সৌন্দর্যের ভেতর ক্রিকেট খেলার প্রশান্তির কথা। এই স্বাদ পাওয়া একজন আছেন এবারের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে। ক্রিকেটের ভেলায় পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পাহাড় ডিঙিয়ে যিনি চলে গিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রের পাড়ে। খেলেছেন পাকিস্তান প্রিমিয়ার লিগেও (পিএসএল)।
এবারের বিপিএলে সালমান ইরশাদকে এনেছে ঢাকা ডমিনেটরস। দলের প্রথম দিনের অনুশীলনের পুরোটা সময়ই ব্যাট-বলে ব্যস্ত ছিলেন। লাসিথ মালিঙ্গার মতো ‘স্লিঙ্গিং’ অ্যাকশনে বল করেন। উচ্চতা ছয় ফুট দুই ইঞ্চি। বিসিবির একাডেমি মাঠে দাঁড়িয়ে সালমান শোনাচ্ছিলেন তার জীবনের গল্প।
পাহাড় ডিঙিয়ে বেড়ে ওঠা। দুই পাহাড়ের মাঝের ফাঁকা জায়গাই ভরসা ছিল ক্রিকেটের জন্য। সালমান বলেন এভাবে, ‘কাশ্মীরকে বলা হয় জান্নাত। চারদিকে পাহাড়, তুষার ঝড়। ওখানে চারটা মৌসুম। কাশ্মীরের জীবন, ক্রিকেট সবই উপভোগ করি...। ’
ক্রিকেট সালমানের কাছে অনেকদিন ধরে ছিল শুধুই উপভোগের ব্যাপার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলেন, শেষ করেছেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং। এরপর একদিন সালমানের সামনে এসে হাজির হলো ‘সোনার হরিণ’ জেতার সুযোগ। আক্ষরিক অর্থেই তাই। কেন?
জবাবে সালমান বলছিলেন, ‘লাহোর কালান্দার্স একটা ট্রায়ালের আয়োজন করলো। কত ছেলে গিয়েছিল জানেন? ৩৫ হাজার। ’ সংখ্যাটি শোনার পর তার কাছে নিশ্চিত করতেই হতো, ‘৩৫ হাজার, আসলেই? ঠিক শুনেছি?’
সালমান সংখ্যাটা নিশ্চিত করে জানালেন আরও বিস্ময়ের এক খবর। ৩৫ হাজারের ভেতর একজনকেই নেওয়া হয়েছিল- তার নাম সালমান ইরশাদ, যার গল্প পড়ছেন আপনি। বিচারকদের কাছে জানতে চাওয়াই সবচেয়ে ভালো হতো। তবুও দায় সারাতে তার কাছেই জানতে চাওয়া হলো। কীভাবে এত বড় পরীক্ষায় উতরে গেলেন?
তিনি জবাব দিলেন, গতি.. ‘‘আমি আসলে ‘র’ প্রতিভা। বলে অনেক গতি ছিল। স্পিড মিটারে আমার গতি ছিল ১৪৫ কিলোমিটার। আপনি চিনবেন কে আমাকে বাছাই করেছিল, আকিব জাভেদ (পাকিস্তানের কিংবদন্তি ক্রিকেটার)...। ’’
এরপর সালমানের জীবন কেবল ছুটেছেই। অস্ট্রেলিয়া নিয়ে গিয়েছিল লাহোর কালান্দার্স। সালমানের ভাষায় ক্রিকেট খেলার জন্য দুনিয়ার সেরা জায়গায়। ওখানে গ্রেড ক্রিকেট খেলেছেন। চার ম্যাচে নিয়েছিলেন ২২ উইকেট। অস্ট্রেলিয়ায় তার জীবনে ঘটেছে অভূতপূর্ব এক ব্যাপারও।
ভারত দল তখন অস্ট্রেলিয়ায়। কেউ তাদের জানিয়েছিল পাকিস্তানের দুই পেসার আছে এখানে। তাদের ডাক পড়ে নেটে। সালমান যে ছিলেন তা এতক্ষণে অনুমান করতে পেরেছেন, অন্যজন ছিলেন হারিস রউফ। দুজনের উঠে আসা একসঙ্গে।
কোহলিকে বল করার ওই অভিজ্ঞতা বলার সময়ে সালমানের আনন্দ ভীষণ স্পষ্ট, ‘পৃথিবীজুড়েই বিরাট কোহলি তারকা। আমিও তার অনেক বড় ভক্ত। তার ওপর ও তখন ওয়ানডে র্যাংকিংয়ের এক নম্বর ব্যাটার। ওই সময় আসলে ভীষণ রোমাঞ্চকর ছিল। ব্যাপারটা ছিল স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো...। ’
অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে সালমান খেলেন পিএসএলে। লাহোর কালোন্দার্সের হয়ে অভিষেক ম্যাচের দুটি ঘটনা শোনাচ্ছিলেন সালমান, ‘একদম প্রথম বলে মিসবাহ উল হককে বোল্ড করেছিলাম। ব্যাটিংয়ে নেমে প্রথম বলে ছক্কা মেরেছি মোহাম্মদ সামিকে...। ’
এরপর সময় গড়িয়েছে, বদলেছে সালমানের জীবনের গতিপথ। পিএসএলে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছেন। ‘পরিশ্রম’ও ধৈর্যকে মেনেছেন জীবনের নিয়তি। সালমানের মন অবশ্য এখনও পড়ে আছে কাশ্মীরের ‘জান্নাতে’।
স্বপ্ন দেখেন, একদিন অনেক ক্রিকেটারই দেখা যাবে তার জন্মস্থান থেকে, ‘(পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত) কাশ্মীরে প্রতিভা আছে অনেক। মাঠ তেমন নেই, চারদিকে শুধু পাহাড়। সমতল জায়গাই কম। তবুও আমি আশাবাদী মানুষ। কাশ্মীর থেকে আরও ক্রিকেটার দেখবেন ভবিষ্যতে। ভারতে উমরান মালিক খেলছে, আমি পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলছি। আরও আসবে ইনশাআল্লাহ। ’
সালমানের জীবন যেভাবে গতিপথ বদলেছে বহুবার, স্বপ্ন ডালপালা মেলাই ভীষণ স্বাভাবিক। কোথায় দেখতে চান নিজেকে? তিনি ভাবেন কিছুক্ষণ। এরপর বলেন ‘জাতীয় দলে...। ’ কথা শেষ করে চলে যেতে যেতে বলেন, ‘বহুদ জলদি সে...’। সালমান কি পারবেন, খুব দ্রুত অথবা পরে? হয়তো হ্যাঁ কিংবা না। তবে তার কারণে কাশ্মীরের ছেলেরা নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। কে জানে, কুর্ণিশ জানাচ্ছে কি না।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৩, ২০২২
এমএইচবি/এমএইচএম