দুরুদুরু বুকের সেই কাঁপুনি আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই। দশম শ্রেণি, মাধ্যমিক পরীক্ষা।
চিরাগ জানির জীবনও থমকে গিয়েছিল এক মুহূর্তের জন্য, কল্পনার চেয়েও বাজেভাবে। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে তার সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল ছিলেন পুলিশ কনস্টেবল বাবা, মা ছিলেন পুরো বিপরীত। দশম শ্রেণিতে ফেল করার পর সেই বাবাই তাকে কিনে দিতে চেয়েছিলেন অটোরিকশা।
সেই চাওয়া তাতিয়ে দিয়েছিল চিরাগ জানিকে। এরপর থেকে স্বপ্নের পথে ছুটে বেড়িয়ে করেছেন অক্লান্ত পরিশ্রম, ভারতের মতো দেশের সেরা পেস বোলিং অলরাউন্ডারদের একজন হয়েছেন। ভিনদেশি এক সাংবাদিকের তাকে নিয়ে যে কৌতূহল সেটা চিরাগ ক্রিকেটার বলেই তো।
বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশ পরিচিত মুখই এখন চিরাগ জানি। এবারও লিজেন্ডস অব রুপগঞ্জের মূল ভরসা তিনি। ঢাকা লেপার্ডের বিপক্ষে ম্যাচের পর চিরাগ যখন বলেছেন তার গল্প, তার খানিক আগেই নিয়ে এসেছেন ম্যাচসেরার পুরস্কার। একই দিনে মাশরাফি তাকে ভাসিয়েছেন প্রশংসায়। ‘এত ভালো স্পিন খেলতে পারে...’, দলের ‘হৃদপিণ্ড’ বা এমন কিছু বলে।
ছোটবেলা থেকেই চিরাগ হতে চেয়েছিলেন অলরাউন্ডার। ব্যাটিং-বোলিং তো তিনি করেন এখনও, এক সময় করতেন কিপিংও। তবুও চিরাগের জীবনে মোটা দাগের আফসোসও থাকার কথা বড়সড়। নিজ দেশে যখন জমজমাট আইপিএলের আসর চলছে, তাতে আছে অর্থের ঝনঝনানিও; চিরাগ তখন ভিনদেশি হয়ে খেলছেন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে।
আফসোস হয় না? প্রশ্নটা শুনেই চিরাগের জবাব, ‘আমার হাতে আছে কেবল পারফরম্যান্স... । ’ এমনিতে তার ক্যারিয়ারের গ্রাফ উর্ধ্বমুখী। সৌরাষ্ট্রের হয়ে রঞ্জি ট্রফি জিতেছেন। বিজয় হাজারে ট্রফির ফাইনালে মহারাষ্ট্রের বিপক্ষে করেছেন হ্যাটট্রিক।
সেই যাত্রাটিতেও ঘুরিয়ে আনেন চিরাগ, ‘আমি যখন বোলিংয়ে আসি, আমার লক্ষ্য ছিল ইয়র্কারটা ঠিকঠাক মতো করা। আমার ইয়র্কারের প্রতি বিশ্বাস ছিল, তিনটি বলই স্টাম্পে রাখতে পেরেছিলাম। আমি খুবই কৃতজ্ঞ যে ফাইনালে হ্যাটট্রিক করতে পেরেছিলাম আর দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সারাজীবনেও এটা ভুলতে পারবো না। ’
অথচ সেই হ্যাটট্রিকের পর কী হয়েছিল সেটি ভুলেই গিয়েছেন চিরাগ। হেসে তিনি বলছিলেন, ‘এমন কিছু ঘটার পর আসলে আপনার খেয়াল থাকবে না কী হচ্ছে। ’ তবে চিরাগের জীবনে হয়েছে অনেক কিছুই। গত কয়েক বছরের ‘ডমিনেটিং’ সৌরাষ্ট্র দলের কারিগরদের একজন তিনি।
চিরাগের ভাষায় অবশ্য তার কৃতিত্ব অধিনায়ক জয়দেব উনাদকাটের দেওয়া ‘একাত্মতার’ বার্তার। অধিনায়কের নাম বলা ক্রিকেটারকে চিনতে পারলেন তো? গত ডিসেম্বরে মিরপুরেই ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় জীবন পেয়েছিলেন যিনি; এক যুগ পর টেস্ট খেলে।
তার নেতৃত্বকেই ব্যাখ্যা করছিলেন চিরাগ, ‘জয়দেব জানে দলকে কীভাবে এগিয়ে নিতে হয় ও ক্রিকেটারদের অনুপ্রাণিত করতে হয়। সে সবসময়ই বলে আমাদের সামর্থ্যের সেরাটা দিতে। ’ ওই দলে তিনি খেলেছেন চেতেশ্বর পূজারার সঙ্গেও।
বাংলাদেশে এসেও চিরাগ পেয়েছেন এক ‘জাদুকরের’ ছায়া। যিনি হাসতে জানেন, একইসঙ্গে ধমকাতে কিংবা আগলেও রাখতে পারেন। মাশরাফি বিন মর্তুজাকে চিরাগ ব্যাখ্যা করেন ‘কিংবদন্তি’ বিশেষণ দেওয়ার পরে। বহু অধিনায়কের অধীনেই তো খেলেছেন, মাশরাফি কোথায় আলাদা?
চিরাগ বলেন এরপর, ‘মাঠে ও মাঠের বাইরে সবকিছুতেই ভিন্ন মাশরাফি ভাই। সব মিলিয়ে শান্ত-শিষ্ঠ। সবকিছু ভালো সামলাতে পারেন ও ইতিবাচকভাবে চিন্তাভাবনা করতে বলেন আমাদের। সাকিব ভাই, মাশরাফি ভাইরা কিংবদন্তি। তাদের থেকে তরুণরা শিখছে। শিখে সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করছে। ’
বয়স ৩৩ হয়ে গেছে। চিরাগের পারফরম্যান্সের ধার অবশ্য কমেনি। এবারের ডিপিএলেই ৯ ইনিংসে ৯৮.৭২ স্ট্রাইক রেট ও ৯২.৪০ গড়ে করেছেন ৪৬২ রান, বল হাতে ঝুলিতে আছে ১৭ উইকেট। দুটির তালিকাতেই আছেন সেরা তিনের ভেতরে। কীভাবে এতটা সফল?
‘ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে এটা আমার তৃতীয় মৌসুম। লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের হয়ে দ্বিতীয় মৌসুম খেলছি। আগে খেলার কারণে এখানকার উইকেট ও কন্ডিশন সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা আছে। চেষ্টা করছি ভালো করতে। দলের জন্য অবদান রাখতে পেরে ভালো লাগছে, উপভোগ করছি, আমি অনেক খুশি। ’
চিরাগের বয়স বাড়লেও স্বপ্ন বা শ্রম কোনোটিই কমেনি। ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, আইপিএল দুটিই খেলার স্বপ্ন দেখি’, এমন কিছু অবলীলায় চলে আসে তার মুখ থেকে। কিন্তু কতটুকু সম্ভব?, ‘আমার কোনো হাত নেই এসবে। হাত আছে পারফরম্যান্স করায় আর পরিশ্রমে। ’
চিরাগ ঠিকই বলেছেন, তিনি স্বপ্ন দেখতেই পারেন। যার অটোচালক হওয়ার কথা ছিল একসময়, তিনি এতদূর এলেন তো স্বপ্নের জোরেই।
বাংলাদেশ সময় : ২১২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০২৩
এমএইচবি/এএইচএস