ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের সেরা দিনই কি পার করলো বাংলাদেশ?

অঘোর মন্ডল, স্পেশালিস্ট স্পোর্টস রাইটার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫১ ঘণ্টা, মে ১, ২০১৫
টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের সেরা দিনই কি পার করলো বাংলাদেশ? ছবি: মানজারুল ইসলাম / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খুলনা থেকে: ক্রিকেটের মহত্ত্ব নিয়ে হাজার হাজার শব্দ খরচ হয়েছে। ক্রিকেটের গৌরব গাঁথায় ব্যবহৃত শব্দগুলোও বহু ব্যবহারে ক্লিশে।

কিন্তু খেলাটা যখন ক্রিকেট পুরনো কথাগুলো আপনাকে লিখতেই হবে। কারণ পুরনো রেকর্ড ঘাটতে ঘাটতেই নতুন রেকর্ডের কথা বলতে হচ্ছে। লিখতে হচ্ছে। রোজ এতো রেকর্ড হচ্ছে, যার হিসেব রাখতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়তে পারেন পরিসংখ্যানবিদরাও!

খুলনা টেস্টের চতুর্থ দিনটাও রেকর্ডের হাত থেকে মুক্তি পেলো না! মে দিবসের ছুটিও মুক্তি দিলো না ক্রিকেট লিখিয়েদের! প্রেসবক্সে বসে তাই মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়েছিল; ‘শ্রমিকের চেয়েও অধম  জীবন! না হলে মে দিবসের ছুটির দিনেও এই সাত সকালে বেরিয়ে পড়তে হবে কেন’! সকালে নিছক রসিকতার ছলে কথাটা বেরিয়েছিল মুখ থেকে। কিন্তু দিন শেষে লিখতে হচ্ছে, টেস্ট ক্রিকেট কি রকম রসিকতা করতে পারে, সেটা হয়তো এতো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারতাম না মে দিবসে কাজ করতে না এলে!

ক্রিকেটে জীবনের ছবি ফুঁটে ওঠে। টেস্ট ক্রিকেটে সেটা আরও বেশি। আর এই কথাটা নতুন করেও বলার কিছু নেই। তবু দিনের শুরু আর শেষে একজনকে দেখে কথাটা বেশি করে মনে পড়ছে। স্বজন হারানোর দুঃসংবাদ দিয়ে তার দিন শুরু। আর দিন শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েও ক্রিকেট তাকে মুক্তি দিলো না; স্বজন হারানোর দুঃখ ভুলে থাকতে! সাফল্যই তাকে টেনে আনলো খুলনা টেস্টের চতুর্থ দিন শেষে সাংবাদিকদের সামনে। তার আগে অবশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সৌজন্যে সাংবাদিকরাও জেনে গেছেন, তামিম ইকবাল তার ফুপুকে হারিয়েছেন। আর দিন শেষে তারাই তামিমের কাছে জানতে চাইলেন, টানা তিন টেস্টে সেঞ্চুরি করলেন। বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে যে কোনো উইকেটে সর্বোচ্চ রানের পার্টনারশিপ গড়লেন। কিন্তু সকালে আপনার মনকে এতোটা শক্ত রাখলেন কিভাবে?

স্বজন হারানোর দুঃখ দূরে সরিয়ে রেখে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। বরং অনেকের কাছে প্রশ্নটাকে তামিমের দুঃখকে উস্কে দেওয়ার মতো মনে হতে পারে! কিন্তু সাংবাদিকরাওতো মানুষ। যদিও কবরস্থান থেকে শ্মশানঘাট যেখানেই যাক না কেন; পেশা তাকে আবেগের রাশ টেনে ধরতে বলে। তামিমের অপরাজিত সেঞ্চুরি (১৩৮*)'র জন্য অভিনন্দন জানিয়েই তাই তার ফুপুকে হারানোর প্রসঙ্গ। পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে তামিমকেও বলতে হলো; ‘খবরটা সকালেই শুনেছিলাম। ভাইয়া (নাফিস ইকবাল) ফোন করেছিল। আমার এই ফুপু খুব ভালো রান্না করতেন। আমি আর আমার আব্বা দু’জনেই খেতে খুব পছন্দ করি। টেলিভিশনের একটা রান্নার অনুষ্ঠান দেখে ফুপু একদিন রান্না করে নিয়ে এসেছিলেন। ওটাই ছিল আব্বা আর আমার শেষ এক সঙ্গে খাওয়া’! আব্বাকে হারানোর পর সেই ফুপুকেও হারালেন তামিম। যে কারণে সকালে ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ সুজনকে একবার বলেছিলেন, ‘আজ যদি আমার ইনিংস শেষ হয়ে যায়, তাহলে আমি কি বাড়ি চলে যেতে পারি?’

তখন বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার কী বলেছিলেন সেটা আর বলার প্রয়োজন পড়েনি। কারণ, তামিম নিজেই! তার ইনিংসই তো শেষ হলো না। ২৮১ মিনিট উইকেটে থেকে ১৩৮ রানে অপরাজিত তিনি। সঙ্গে অপরাজিত আরেক ওপেনার ইমরুল কায়েস। তার নামের পাশে ১৩২ রান। আর বাংলাদেশের সংগ্রহ বিনা উইকেটে ২৭৩ রান। এর আগে ৭৮টা টেস্ট খেলা বাংলাদেশ শেষ কবে এরকম দৃশ্য দেখতে দেখতে মাঠ ছেড়েছে কেউ মনে করতে পারছেন না। তবে একটা জিনিস মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে, টেস্ট ইতিহাসে বাংলাদেশের যে কোনো উইকেটে সর্বোচ্চ রানের পার্টনারশিপটা গড়লেন তামিম এবং ইমরুল। এই দু’জনে এর আগেও একসঙ্গে একইদিনে একই ইনিংসে সেঞ্চুরি করেছেন।

২০১৪'তে চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তামিম এবং ইমরুল সেঞ্চুরি করে ২২৪ রানের ওপেনিং জুটি গড়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রানের পার্টনারশিপের মালিকানা ছিল এতো দিন মোহাম্মদ আশরাফুল আর মুশফিকুর রহিমের। ২০১৩'তে গলে শ্রীলংকার বিপক্ষে পঞ্চম উইকেটে ২৬৭ রান তুলেছিলেন তারা। সেই রের্কডকে ‘অতীত নামক লকারে’ পাঠিয়ে দিলেন তামিম এবং ইমরুল। এমনভাবে, যা দেখে পাকিস্তানিদেরও বলতে হলো, তাদের বিপক্ষে এরকম দাপটের সঙ্গে আগে কখনো বাংলাদেশের কেউ টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাট করেননি!

দিন শেষে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন আসাদ শফিক। কোনো রকম রাখঢাক না রেখে তিনি স্বীকার করলেন, ‘আমরা তেমন কোনো ভুল করেছি বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের দুই ব্যাটসম্যান এতো ভালো ব্যাট করেছেন, আমাদের পক্ষে আর কি-ই বা করার ছিল’!

শুধু ব্যাটিং কেন। চতুর্থদিনে বাংলাদেশ যে বল করলো, তাতে সেই পুরনো কথাই বলতে হচ্ছে; টেস্ট ক্রিকেট কতো রহস্যময়! কখন কিভাবে র‌‌ঙ পাল্টায় কেউ বলতে পারেন না! আঙুলে ব্যথার কারণে  চতুর্থ দিনেও বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিলেন যিনি সেই তামিম ইকবালও বলতে বাধ্য হলেন; ‘সত্যি কথা হচ্ছে, আমিও আগে ভাবিনি পাকিস্তানকে আজ সকালে এতো তাড়াতাড়ি অল আউট করতে পারবো। আমাদের বোলাররা খুব ভালো বল করেছে। তাইজুল ৬ উইকেট নিয়েছে’।

তবে সকালে বাংলাদেশকে প্রথম ব্রেকথ্রুটা এনে দেন মোহাম্মদ শহীদ। সরফরাজ আহম্মেদের উইকেট নিয়ে টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু করলেন তিনি। এরপর ওহাব রিয়াজের উইকেট নেন তাইজুল। আর এক বাঁহাতি স্পিনার সাকিব আল হাসান আগের দিন  রান দেয়ার ক্ষেত্রে সেঞ্চুরি করে উইকেটহীন  থাকলেও চতুর্থদিনে আসাদ শফিকের উইকেট নিলেন এবং সেটা তৃতীয় নতুন বল নেওয়ার পর। আগের দিনের  ৫ উইকেটে ৫৩৭ রান নিয়ে পাকিস্তান অলআউট হয়ে যায় ৬২৮ রানে। সব মিলিয়ে ২৯৬ রানের লিড পায় সফরকারীরা। কিন্তু তামিম আর ইমরুলের ব্যাটিংয়ে সেই লিড কমে দাঁড়িয়েছে ২৩-এ! আর বাংলাদেশ এমন একটা অবস্থায় দাঁড়িয়ে চতুর্থ দিনটা শেষ করলো যেখান থেকে ম্যাচ বাঁচানোর কথা নয়, পাকিস্তানকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার কথাও ভাবতে পারে। তবে একটা কথা আবারও লিখতে  হচ্ছে, ক্রিকেট কখন কার সঙ্গে কি নির্মম রসিকতা করবে কে জানে!

তবে রসিকতা নয়, একটা ক্রিকেটীয় বাস্তবতার কথা মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে, খুলনা টেস্টে বাংলাদেশের হয়ে তিনজন কিংপিং করেছেন! ক্রিকেট ইতিহাসে অবশ্য এক টেস্টে চারজনের কিংপিং করার নজিরও আছে। ১৯৮৬ সালে লর্ডসে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ব্রুস ফ্রেঞ্চ, বিল অ্যাথে, বব টেইলর আর বরি পার্কস কিপিং করেছিলেন। এই টেস্টে ডান হাতের অনামিকায় ব্যথা পাওয়ায় মুশফিক কিপিং করতে পারেননি ম্যাচের তৃতীয় দিন থেকে। তার জায়গায় প্যাড পরে গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন ইমরুল কায়েস। কিন্তু তাকে যে আবার ইনিংস ওপেন করতে হবে, এটা মাথায় রেখে এক পর্যায়ে মাহমুদুল্লাহকে দাঁড়াতে হলো উইকেটের পেছনে। শুধু দাঁড়ালেন না। তার নামটাও জড়িয়ে থাকলো জুলফিকার বাবরের আউটের সঙ্গে। তাইজুলের বলে উইকেট ছেড়ে বেরিয়েছিলেন বাবর। কিন্তু মিস করলেন বল। আর সেই বল মাহমুদুল্লাহর প্যাডে লেগে স্টাম্পের বেল পড়ে যায়! 'বাবর স্টাম্পড মাহমুদুল্লাহ ব তাইজুল ১১'। সেই সঙ্গে শেষ হয়ে যায় পাকিস্তানের ইনিংস। আর বাঁহাতি স্পিনার তাইজুলের বোলিং ফিগারটা দাঁড়ালো ৪৬ দশমিক ৪ ওভারে ১৬৩ রান দিয়ে ৬ উইকেট।

৬ উইকেট নিয়েও দিন শেষে আলোচনা থেকে প্রায় ফ্রেম আউট হয়ে গেলেন তাইজুল! তামিম আর ইমরুল কায়েস অনেক বেশি ভালো ব্যাটিং করলেন যে! বাংলাদেশ এতো ভালো একটা দিন পার করলো, যা নিয়ে তর্ক হতে পারে টেস্ট ক্রিকেটে এটাই কী বাংলাদেশের সেরা দিন? যারা বলবেন, এর চেয়ে ভালো দিন টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ পার করেছে আগে, তাদের শুধু একটা কথা মনে করিয়ে দেওয়ার আছে, মে দিবসে শ্রমিকের রাস্তায় হাঁটেনি বাংলাদেশ! তামিম-ইমরুল রাজকীয় ব্যাটিং করেছেন। দুই সেশনেরও বেশি সময় পাকিস্তানিদের শ্রমিকের মতো পরিশ্রম করিয়েছেন তারা! বাউন্ডারি রাইন থেকে বল কুড়িয়ে আনতে! আর কী পারিশ্রমিক পেলেন; তা বোঝানোর জন্য একটা তথ্য দিতে হচ্ছে; যে পাঁচজন বোলার ব্যবহার করেছেন পাকিস্তান অধিনায়ক মিসবাহ, তাদের নামের পাশে প্রচুর রান আছে! কিন্তু উইকেট নাই! টেস্ট ক্রিকেট কী নির্মম রসিকতাই না করতে পারে!

** কড়া জবাব টাইগারদের

বাংলাদেশ সময়: ২১৪৬ ঘণ্টা, মে ০১, ২০১৫
আইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।