ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

বাঁহাতিদের ব্যাটিংয়ে খুলনা টেস্ট বাংলাদেশের হয়ে থাকলো

অঘোর মন্ডল, স্পেশালিস্ট স্পোর্টস রাইটার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৬ ঘণ্টা, মে ২, ২০১৫
বাঁহাতিদের ব্যাটিংয়ে খুলনা টেস্ট বাংলাদেশের হয়ে থাকলো

খুলনা থেকে: ইংরেজিতে একটা কথা আছে ‘রানিং ডাউন দ্য থ্রোট’। কাছাকাছি বাংলাÑ ‘গলা দিয়ে নামা’।

হ্যাঁ, অনেককে অনেক কিছু গিলতে হচ্ছে। খুলনা টেস্ট অনেককে অনেক কিছু গিলতে বাধ্য করলো।

 এই টেস্ট শুরুর আগে অনেক বেশি আশাবাদী, অনেক স্বপ্নবিলাসী বাঙালিও  হয়তো ভাবতে পারেননি টেস্টের শেষ দিনটা পাকিস্তানিদের এরকম দু:স্বপ্নের মতো কাটবে!  পাকিস্তানের দু:স্বপ্ন মানে তো বাংলাদেশের স্বপ্নসাগরে ভাসা! না, জয়ের স্বপ্ন হয়তো দেখেনি বাংলাদেশ। কিন্তু এই ম্যাচ বাংলাদেশ হারছে না, তাতো পঞ্চম দিন চা-বিরতির আগেই টের পাওয়া গেছে। কারণ, পাকিস্তানের ২৯৬ রানের লিডকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ লিড নিয়েছে লাঞ্চ ব্রেকের আগেই। এবং সেটা দুই ওপেনার তামিম ইকবাল আর ইমরুল কায়েস অবিচ্ছিন্ন থেকে। তারপর সেই লিডটা কেবল বেড়েই গেছে। মাঝখানে গোটা ছয়েক উইকেট হারিয়েছে বাংলাদেশ। তবে পাকিস্তানি বোলারদের বিপক্ষে নিজেদের ক্রিকেটীয়  বীরত্বের সর্বোচ্চ নজির রেখে। আর তার প্রমাণ? পাকিস্তানের টেস্ট ইতিহাসে তাদের বিপক্ষে দ্বিতীয় ইনিংসে এর আগে এতো রান কোনো দল করতে পারেনি! যেটা করলো বাংলাদেশ। বিংশ শতাব্দী আর একবিংশ শতাব্দী মিলিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে পাকিস্তানের বয়স ৬৩  বছর। এতো লম্বা সময়ে অনেক বড় বড় ব্যাটসম্যান খেলেছেন পাকিস্তানের বিপক্ষে। কিন্তু পাকিস্তানি বোলাররা কখনো দেখেননি দ্বিতীয় ইনিংসে তাদের বিপক্ষে স্কোরবোর্ডে ৫৫৫। খুলনায় সেটা দেখলেন। স্কোরবোর্ডে ফাইভ ফিফটি ফাইভ দেখে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের মনে পড়তে পারে বিজ্ঞাপনের সেই ভাষাটা। শুধু গোটাকয় শব্দ একটু পাল্টে নিতে হবে:। ‘ ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ’এর পরিবর্তে তাঁরা পড়তে পারেন:  ‘বাংলাদেশের বিপক্ষে বল করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ’

হ্যাঁ, তামিম ইকবাল এবং ইমরুল কায়েস যা ব্যাটিং করলেন দ্বিতীয় ইনিংসে, তাতে করে পাকিস্তানের টেস্ট জয়ের স্বপ্নটাই শুধু শেষ হয়ে যায়নি, সেই সঙ্গে  বোলিং শক্তি নিয়ে পাকিস্তানিদের গর্বেরও  একটা স্মৃতিসৌধ তৈরি হয়ে গেল খুলনা স্টেডিয়ামে! হ্যাঁ, স্মৃতিসৌধ ছাড়া কি আর বলবেন! টেস্ট ক্রিকেটে এর আগে পাকিস্তানিদের বিপক্ষে দ্বিতীয় ইনিংসে এতো রান কেউ তুলতে পারেনি। বাংলাদেশ তুললো। এবং  সেটা তামিম ইকবাল আর ইমরুল কায়েসের রেকর্ড পার্টনারশিপের সৌজন্যে। আসলে এতো রেকর্ড বাংলাদেশের এই ইনিংসে, কোনটা রেখে কোনটার কথা লিখবেন আপনি! দ্বিতীয় ইনিংসে  পাকিস্তানের বিপক্ষে যে কোনো দলের সর্বোচ্চ রান ৬ উইকেটে ৫৫৫ রান। ওপেনিং জুটিতে তামিম আর ইমরুল যা করলেন, তাতে টান পড়লো ৫৫ বছর আগে গ্রাহাম পোলার আর কলিন কাউড্রের করা দ্বিতীয় ইনিংসে উদ্বোধনী জুটিতে তোলা সেই ২৯০ রানের পার্টানারশিপও। ওভালে সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে ঐ রের্কড গড়েছিলেন এই দুই ইংলিশ ওপেনার। কিন্তু সেটাকে আর অক্ষত থাকতে দিলেন না তামিম-ইমরুল। তারা উদ্বোধনী জুটিতে দ্বিতীয় ইনিংসে করলেন ৩১২ রান। এই রান করার পথে আরো দুই ইংলিশ ওপেনারের  অন্যরকম এক রেকর্ডকেও চাপা দিয়ে গেল বাংলাদেশি দুই ওপেনারের রানের চাকা। টেস্ট ক্রিকেটে দুই বাঁহাতি ওপেনারের সবেচয়ে বেশি রানের রেকর্ড ছিলো মার্কাস ট্রেসকোথিক আর অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসের। ডারবানে ২০০৪ সালে তারা সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে করেছিলেন ২৭৩ রান। সে রেকর্ডকেও অতীত বানিয়ে দিলেন তারা। ইমরুল যখন ১৫০ রানে আউট হলেন, দুই বাবরের যুগলবন্দীতে (কট আজম বাবর ব  জুলফিকার বাবর) তখন বাংলাদেশের এই দুই বাঁহাতির নাম ব্র্যাকেটবন্দী হয়ে গেলো অনেক রেকর্ডের পাশে। বাংলাদেশের পক্ষে যে কোনো উইকেটে সর্বোচ্চ, রানের পার্টনারশিপ গড়েছিলেন তারা আগের দিন-ই।   শেষ দিনে গড়লেন যে রেকর্ড তা হয়ে গেলো বিশ্বরেকর্ড! তবে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি রানের ইনিংসের মালিকানারও এদিন হাতবদল হলো--- মুশফিকের হাত থেকে তামিমের হাতে। তামিমের ২০৬ রানের ইনিংসটাই এখন টেস্টে কোনো বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। যা তিনি খেললেন পাকিস্তানের বিপক্ষে। এবং দুর্দান্ত দাপটের সঙ্গে। ৪৪৮ মিনিট উইকেটে থাকলেন। ২৭৮ বল খেললেন। করলেন ২০৬ রান। এ দিয়ে অবশ্য তামিমের ইনিংসের ভয়ংকর সুন্দর ব্যাপারটা পুরোপুরি বোঝানো যাবে না। তবে গোটা কয়েক স্ট্রোকের একটু বর্ণনা দিলে হয়তো একটা খণ্ডচিত্র ভেসে উঠতে পারে পাঠকের মনে। ১৮২ রান থেকে ইয়াসির শাহকে লং অন দিয়ে ছক্কা মেরে পৌঁছে গেলেন ১৮৮-তে। ওয়ান নাইটিজে ঢুকলেন তিনি আবারও সেই ইয়াসির শাহকেই ছক্কা মেরে। এবারও এই লেগ স্পিনার চেয়ে চেয়ে দেখলেন বল লং অনের উপর দিয়ে ভেসে গেলো বাউন্ডারি লাইনের ওপারে। পরের বল সুইপ করে সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইকিং এন্ডে থাকলেন তামিম। বাঁহাতি ফাস্ট বোলারকে স্ট্রেট ওভার বাউন্ডারি মেরে ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করলেন তামিম। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি রানের ইনিংসের মালিকও বনে গেলেন। আগে এই রেকর্ডটা ছিল মুশফিকের। তিনি করেছিলেন ঠিক দু’শ রান। দিন শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে মুশফিক বলে ফেললেন  ‘ জানতাম রেকর্ডটা বেশি দিন টিকে থাকবে না।   রেকর্ড ভেঙে গেলে একটু খারাপই লাগে। তবে ভাল লাগছে আমার চোখের সামনে তামিম সেটা ভাঙলো। ’ আর যিনি নতুন রেকর্ডের মালিক হলেন, মুশফিকের সেই ডেপুটি আরো বেশি পেশাদারি শ্রদ্ধা দেখিয়ে বললেন, ‘আমি নিশ্চিত আমার এই রেকর্ড কেউ না কেউ ভাঙবে। এবং সেটা খুব তাড়াতাড়ি। ’
তামিম টেস্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি রানের ইনিংস খেলা ব্যাটসম্যানই শুধু নন, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও তিনি বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের মালিক।

এরকম রেকর্ডের মালিকানা বদলের দিনে প্রচারের আলো থেকে প্রায় আড়ালে চলে যাচ্ছিলেন ইমরুল কায়েস। কিন্তু তিনিও খেললেন তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। তামিমের ইনিংসে যেমন আগ্রাসী ভাবটা একটু বেশি ফুটে উঠেছে, ইমরুলের ইনিংসটা হয়তো সেরকম নয়। তবে কার্যকারিতার দিক থেকে অনেক মূল্যবান। পাকিস্তানের বিপক্ষে কোনঠাসা অবস্থা থেকে যে ঘুরে দাঁড়ালো বাংলাদেশ! দিনশেষে প্রায় জয়ের সমান ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়লো তারা! এর পেছনে ইমরুল কায়েসের ইনিংসটা বড় ভূমিকা রাখলো। আর ইমরুল?  মুশফিক আঙুলে আঘাত পাওয়ার পর একশ ওভারেরও বেশি কিপিং করে যে ইনিংস তিনি খেললেন, তাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?  ‘আমি টেস্ট দলে থাকবো কি না, তা নিয়েও আমার মনে একটা সংশয় ছিল। চারিদিকে অনেক কথা হচ্ছিলো বিশ্বকাপে ভাল খেলতে না পারায়। তাই চেষ্টা করেছি সুযোগটাকে কাজে লাগাতে। ’ খুব সহজ-সরলভাবে বলে গেলেন ইমরুল কায়েস। তবে এর মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটনীতিরও একটা দীনতা বেরিয়ে পড়লো। আগের তিন টেস্টে দুটো সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যানকেও পরের টেস্টে দলে থাকবেন কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়! অন্য দেশের টেস্ট ক্রিকেটাররা অন্তত এই জায়গাটায় ইমরুলদের চেয়ে অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকেন।

আসলে ক্রিকেটে সুবিধাজনক অবস্থায় আছি ভেবে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। সেটা পাকিস্তান টের পেলো আরো একবার। চতুর্থদিন শেষে পাকিস্তানই তো এই টেস্টে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। কিন্তু পঞ্চম দিনে সেই পাকিস্তানকে ওভাবে ব্যাকফুটে ঠেলে দেবে বাংলাদেশ, কে ভাবতে পেরেছিলেন? যা ভাবা যায় না, ক্রিকেট সেরকম অনেক কিছুরই জন্ম দেয়। এটাই টেস্ট ক্রিকেটের সৌন্দর্য। তামিমের ব্যাটিং যদি দেখার জন্য অন্যরকম এক সৌন্দর্য ছড়িয়ে থাকে, তাহলে তাঁর পাশে ইমরুল কায়েসের ব্যাটিংটা সমৃদ্ধ করলো বাংলাদেশ ক্রিকেটকে। পাকিস্তানের বিপক্ষে আগে যেখানে আট টেস্টের চারটাতেই ইনিংস পরাজয় মেনে নিতে হয়েছিল, সেই পাকিস্তানকে ড্র মেনে নিয়ে মাঠ ছাড়তে হলো নবম টেস্টে এসে। এবং সেটা ঐ দুই বাঁ-হাতির ব্যাটিংয়ে। সঙ্গে অবশ্য আরেক বাঁহাতি সাকিবও খেললেন অপরাজিত ৭৬ রানের ইনিংস। আরও এক বাঁ-হাতি সৌম্য সরকার ৩৩ রানে থেমে গেলেন। সব মিলিয়ে অবশ্য বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসটা মনে হতে পারে, বাঁ-হাতিদের গল্প!

 এবং হ্যাঁ,বাংলাদেশের বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানরা নিজেদের মেলে ধরার জন্য এমন একটা দিনকেই বেছে নিলেন, যেদিনটা টেস্ট ক্রিকেটে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ (৪০০*) রানের ইনিংসের মালিক আরেক বাঁহাতি ব্রায়ান চার্লস লারার জন্মদিন। এই দিনটাতেই যেন বাংলাদেশ ক্রিকেটেও একটা নতুন দিনের শুরু হলো। খাদের কিনার থেকেও ঘুরে দাঁড়াতে শিখেছে বাংলাদেশ, ক্রিকেটবিশ্ব সেটাই দেখলো। কিন্তু সেইসঙ্গে এতোদিন বাংলাদেশের টেস্টমান নিয়ে যারা বিদ্রূপ করেছেন, তাদের অনেককেই নিজেদের কথা এখন গিলতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ২১৩৫ ঘণ্টা, মে ০২, ২০১৫
সম্পাদনা: জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।