মুম্বাই থেকে: আরব সাগর বিধৌত ভারতের ক্রিকেট রাজধানী মুম্বাই। সাগরের একেবারে তীর ধরে মু্ম্বাই শহরের বুক চিড়ে চলে গেছে মেরিন ড্রাইভ রোড।
যেখানে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শচীন টেন্ডুলকারের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম।
ওয়াংখেড়ে আর শচীন টেন্ডুলকার যেন এক সুতোয় গাঁথা দু’টো নাম। কেননা ১৯৭৩ সালের ২৪ এপ্রিল জন্ম নেওয়া এই ক্রিকেট ওয়ান্ডারের ঘরের মাঠ এই ওয়াংখেড়ে।
এই ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামেই ১৯৮৮ সালের ১১ ডিসেম্বর মাত্র ১৫ বছরের বয়সে বোম্বের হয়ে ভারতর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট রঞ্জি ট্রফি দিয়ে ক্রিকেট অঙ্গনে যাত্রা শুরু করেন লিটল মাস্টার।
আর ওই অভিষেক ম্যাচেই গুজরাটের বিপক্ষে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ভারতের সব চাইতে কম বয়সী সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে ভারত বর্ষের সমৃদ্ধ ক্রিকেটের ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লেখান শচীন।
সেই থেকে শুরু... সব চাইতে কম বয়সে সেঞ্চুরি করে পুরো ভারত বর্ষ চমকে দিয়ে তার ঠিক পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮৯ সালের ১৫ নভেম্বর করাচিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যচ দিয়ে টেস্ট এবং একই সফরে ১৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক হয় ক্রিকেট ঈশ্বর শচীনের।
এরপর টানা ২৪ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার শেষে এই ওয়াংখেড়ে দিয়েই ২২ গজের জীবনের সমাপ্তি টানেন শচীন। এই স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাসের গালিচায় দাঁড়িয়েই মর্মস্পর্শী বিদায়ী ভাষণ দিয়ে ভারতবাসীর চোখের জল ঝড়িয়েছিলেন তিনি।
শুধু শচীনই নন, এই মাঠেই ছয় বলে ছয়টি ছক্কা মেরে ক্রিকেটে অমর এক কীর্তি গড়েছিলেন ভারতের ক্রিকেটার রবী শাস্ত্রী।
আর এখানেই ৩১ মার্চ (বৃহস্পতিবার) স্বাগতিক ভারতের মুখোমুখি হচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বুধবার এ স্টেডিয়ামেই হয় ম্যাচ পূর্ব সংবাদ সম্মেলন। স্টেডিয়ামের ২ নম্বর গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই ঠিক ডান দিকেই চোখে পড়লো মুম্বাই ক্রিকেট সেন্টার। সাদা ইট ও রঙিন কাঁচের নতুন অবকাঠামোর মুম্বাই ক্রিকেট সেন্টার ভবনটি দেখেই মনের গহীনে কেমন অজানা একটি ভালো লাগা কাজ করতে লাগলো।
মুম্বাই ক্রিকেট সন্টারের এমন সৌন্দর্য অপলক চোখে দেখতে দেখতে কয়েক কদম পার হওয়ার পরই শুরু হলো স্টেডিয়ামের মুল আঙ্গিনা।
বাইরে দেখে মনেই হয়নি যে স্টেডিয়ামটি ১৯৭৪ সালে নির্মাণ করা হয়েছে। কেননা প্রতিষ্ঠার পর ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনাল ম্যাচের জন্য স্টেডিয়ামের পুনর্গঠনের কাজ সম্পন্ন করা হয়।
প্রায় ৩৪ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন স্টেডিয়ামটি দেখতে ততোটা আকর্ষণীয় না হলেও এর ভেতরে সব কিছুই বেশ আধুনিক।
গ্যালারি থেকে শুরু করে, প্রেস বক্স, মাঠ এবং ভিআইপি ও ভিভিআইপি স্ট্যান্ডগুলোর আধুনিকতা ও স্থাপত্যশৈলী যে কাউকেই বিমোহিত করবে।
ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের দর্শকদের জন্য রয়েছে ৮টি গ্যালারি। এগুলো হচ্ছে- সুনীল গাভাস্কার স্ট্যান্ড, নর্থ স্ট্যান্ড, বিজয় মারচেন্ট স্ট্যান্ড, শচীন টেন্ডুলকার স্ট্যান্ড, এমসিএ স্ট্যান্ড, ভিত্থল ডেভচা স্ট্যান্ড, গরওয়ার স্ট্যান্ড ও গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড।
আধুনিক মননে তৈরি স্ট্যান্ডগুলো থেকে দর্শকেরা বেশ স্বাচ্ছন্দেই খেলা উপভোগ করতে পারেন।
এর বাইরেও ভালো লাগার যে ব্যাপারটি এখানে এলে কাজ করে তা হলো, আরব সাগর থেকে আসা হিম ঠাণ্ডা বাতাস। গ্যালারিতে বসে খেলা দেখার সময় ওই হিম বাতাসের প্রতিটি পসলা যে কারোর শরীর-মনে আনন্দের এক অজানা ঢেউ বইয়ে দেবে।
একবার ভাবুন তো, ওয়াংখড়েতে বসে আপনি খেলা দেখছেন আর সাগরের উত্তাল তরঙ্গের শব্দ আপনার কানে এসে আছড়ে পড়ছে! প্রকৃতির এমন অপার সৌন্দর্যে আবৃত এই ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে কী যে অনাবিল এক ভালো লাগার আবহ ছড়িয়ে থাকে তা নিজ চোখে না দেখলে হয়তো বিশ্বাস হবে না।
ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামটির আরেকটি আলোচ্য বিষয় হলো এর পিচ। পেস বোলারদের জন্য মাঠের পিচটি সুইং স্বর্গ নামে খ্যাত। দিনের প্রথমভাগে পেসাররা এই পিচে বল করতে এলে বেশ সুইং পেয়ে থাকেন।
শুধু পেসই নয় স্পিনারদের জন্যও পিচটি বেশ সহায়ক। টেস্ট সিরিজে শেষ দুই দিন স্পিনাররা বল করতে এলে বেশ ভালোই টার্নিং পেয়ে থাকেন।
তবে শুধু বোলাররাই নন, ব্যাট হাতে ব্যাটসম্যানেরাও পেয়ে থাকেন সমৃদ্ধ রানের সংগ্রহ তাই পিচটিকে রান প্রসবা বললেও ভুল হবে না।
কেননা, ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে এই মাঠেই ভারত সফরে এসে ৬ উইকেটে ৬০৪ রানের বিশাল সংগ্রহ গড়েছিল সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
শুধু টেস্টেই নয়। সম্প্রতি ২০১৫ সালে ভারত সফরে এসে ৫ ম্যাচ সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে এখানেই ৪ উইকেটে ৪৩৮ রানের সংগ্রহ পেয়েছিল সফরকারী দক্ষিণ আফ্রিকা।
পিচের পর এবার আসা যাক প্রেস বক্সের আলোচনায়। মূল গেট ধরে নিচ তলা দিয়ে হেঁটে এলে শচীন টেন্ডুলকার স্ট্যান্ড পার হয়ে লিফটে বা সিঁড়ি দিয়ে উঠলে তিন তলায় অবস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের কর্মস্থল প্রেস বক্সটি।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন এই প্রেস বক্সে বসে এক সঙ্গে প্রায় ১৫০ জন সংবাদ কর্মী কাজ করতে পারেন।
সাংবাদিকদের বসার আসন থেকে শুরু করে ইন্টারনেট সেবা, ডাইনিং, ওয়াশরুম সবই বেশ উন্নত।
বিশ্বকপের সংবাদ সংগ্রহ করতে এসে ওয়াংখেড়ের এমন সৌন্দর্য দেখে যে ভালোলাগার সৃষ্টি হয়েছে, তার আবেশ রয়ে যাবে আমৃত্যু! সত্যিই অপূর্ব ওয়াংখেড়ে। দারুণ স্মৃতিময়! দারুণ ভালো লাগার!
বাংলাদেশ সময়: ০৮১১ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৬
এমএ/