ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

‘ভারত বিরোধিতা’র এই জায়গা তৈরি কার?

হুসাইন আজাদ, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১, ২০১৬
‘ভারত বিরোধিতা’র এই জায়গা তৈরি কার?

‘একসময় ইন্ডিয়াকে সার্পোট করতাম। এখন আর করি না! আজ ইন্ডিয়া হেরেছে, আমার কাছে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতেছে।

এতো আনন্দ কই রাখি?’ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ভারতের পরাজয়ে ফেসবুকে এই উচ্ছ্বাসী মন্তব্য করেছেন তরুণ সংবাদকর্মী মোহাম্মদ ওমর ফারুক।

কেবল ওমর ফারুকই নন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ভারতের হারের পর এই ‘অদ্ভ‍ুত’ উচ্ছ্বাসে মেতেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। বিরাট কোহলিকে ছক্কা মেরে আন্দ্রে রাসেল ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয় নিশ্চিত করার পর ঢাকার আকাশে আতশবাজিও ফাটানো হয়েছে। এই আতশবাজি যারা ফাটিয়েছেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ওমর ফারুকের মতো একসময় ভারতীয় ক্রিকেট দলের নিবেদিত সমর্থক ‘ছিলেন’।

প্রশ্ন এখন, কেন ‘ছিলেন’ বলতে হচ্ছে। একটা সময় যে দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের প্রিয় খেলোয়াড়ের নাম জিজ্ঞেস করা হলে ‘সুনীল গাভাস্কার’, ‘শচীন টেন্ডুলকার’, ‘সৌরভ গাঙ্গুলী’, ‘রাহুল দ্রাবিড়’, ‘জহির খান’দের নাম বলা হতো সবচেয়ে বেশি, সেই দেশের সংবাদকর্মী-সংস্কৃতিকর্মী থেকে শুরু করে রাজপথের শ্রমিকটি পর্যন্ত কেন ‘গাভাস্কার-সৌরভ-শচীন-দ্রাবিড়-জহিরদের’ দলের পরাজয়ে ফেসবুকে উল্লাস প্রকাশ করবেন, কেন আকাশে ফাটাবেন আতশবাজি? দৃশ্যত মাত্র এক দশকের মধ্যে ‘অকুণ্ঠ সমর্থনে’র জায়গা কীভাবে এমন ‘কড়া বিরোধিতা’য় রূপ নিলো?

পাকিস্তানের ক্রিকেটপ্রেমীদের ভারত বিরোধিতার প্রধান কারণ, একাধিকবার দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ এবং মনস্তত্ত্বসহ নানামাত্রিক প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশের সঙ্গে তো ভারতের এমন কোনোই যুদ্ধ হয়নি। বরং মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে, আগে ও পরে বাংলাদেশকে অকৃত্রিম সহযোগিতা দিয়ে এই দেশের মানুষের হৃদয়ে পোক্ত জায়গা করে নিয়েছেন তারা। এই অকৃত্রিম সহযোগিতা এখনও রয়েছে বিধায় দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কেও নজিরবিহীন উন্নতি চোখে পড়ছে।

তবু কেন এই ‘বিরোধিতা’? এর উত্তর খুঁজতে বছরখানেক আগ থেকে এ পর্যন্ত সময়ের ‘স্মৃতিচারণ’ হোক। ২০১৫ অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড ওয়ানডে বিশ্বকাপ এই ‘বিরোধিতা’র জায়গা তৈরির প্রধান ভিত্তি হয়ে আছে টাইগার ক্রিকেটসমর্থকদের কাছে। ওই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার কোয়ার্টার ফাইনালে আম্পায়ারদের কয়েকটি সিদ্ধান্তে বিতর্কের ঝড় ওঠে। এজন্য খোদ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআই ও ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির বিরুদ্ধেই অভিযোগের আঙুল তোলা হয়। যার জেরে আইসিসির প্রেসিডেন্ট আ হ ম মুস্তাফা কামালকে শিরোপা বিতরণী অনুষ্ঠানে বয়কট করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষোভ প্রকাশ করে সরে দাঁড়ান আইসিসি প্রেসিডেন্ট।

ওই বিতর্ক আরও উস্কে দেয় সেসময় ভারতীয় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত ‘মওকা মওকা’ শীর্ষক কয়েকটি বিজ্ঞাপন। ওই বিজ্ঞাপনগুলোতে অন্য দলের পাশাপাশি বাংলাদেশ দলকেও ভীষণরকম খাটো করা হয়, করা হয় উপহাস-বিদ্রুপ। এছাড়া, কোয়ার্টার ফাইনালে এমন জালিয়াতির পর বাংলাদেশি ক্রিকেট সমর্থকরা ক্ষোভ প্রকাশ করলে সেগুলো নিয়ে বিদ্রুপাত্মক সংবাদ প্রকাশ করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম। কিছু কিছু সংবাদমাধ্যম আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত মানতে না পারায় বাংলাদেশ দলের ‘পেশাদারিত্ব’ নিয়েও প্রশ্ন তোলে। তাদের সেসব প্রতিবেদন ফেসবুকে পোস্ট করা হলে তার প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় সমর্থকরা বাংলাদেশ ও টাইগার ক্রিকেটারদের কটূক্তি, বিদ্রুপ, এমনকি গালিগালাজ পর্যন্ত করতে ছাড়েননি। ভারতীয় সমর্থক ও সংবাদমাধ্যমগুলোর এ ধরনের অবস্থান বাংলাদেশি সমর্থকদের আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। সে ক্ষোভ তারা উগরে দেন ভারত সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজিত হয়ে বাড়ি ফেরায়, ঠিক এমনই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে।

মাঝে ভারতীয় দল বাংলাদেশ সফরে এলে সেই ‘মওকা মওকা’র জবাব পেয়ে যান মহেন্দ্র সিং ধোনিরা। তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজে তারা বাংলাদেশের কাছে হেরে যান ২-১ ব্যবধানে। এই সিরিজকে ঘিরে স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা খানিকটা কমলেও আবার বেড়ে যায় বিশ্বকাপের আগে শেষ হওয়া এশিয়া কাপের ফাইনাল ঘিরে। সেসময় বাংলাদেশের ‘গতিতারকা’ তাসকিন আহমেদের হাতে মহেন্দ্র সিং ধোনির রক্তাক্ত মুণ্ডুর একটি ছবি ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে নিন্দার ঝড় ওঠে। নিন্দাটা বেশি করেন বাংলাদেশের ক্রিকেট-সমর্থকরাই। অনেক ক্রিকেটসমর্থক ওই ছবি ছড়ানোর পেছনে জড়িতদের খুঁজে বের করারও দাবি তোলেন। কিন্তু সেই ছবিটি নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে ‘বাড়াবাড়ি রকমের’ প্রতিবেদন করা হয়। ভারতের একটি টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে বাংলাদেশ দলকে ক্ষমা চাওয়ার দাবিও করা হয়। কিন্তু এই ছবিটি ছড়ানো নিয়ে এক ভারতীয় জড়িত বলে বাংলাদেশি সমর্থকরা ‘তথ্য-উপাত্ত’ দিলেও ফাইনালের পর ঠিক উল্টো আরেকটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে দেখা যায়, এবার তাসকিনেরই রক্তাক্ত মুণ্ডু ধোনির হাতে।

এ নিয়ে দু’দেশের ক্রিকেট সমর্থকদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক তর্কযুদ্ধ চলতে থাকে। এরমধ্যে বাংলাদেশ দল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে ভারতে উড়াল দেয়। হিমাচলের মতো বৈরী এলাকায় বাংলাদেশ দলের একের পর এক খেলার সূচি রাখা নিয়ে অল্পস্বল্প কথা উঠলেও টাইগাররা হেসে-খেলে জিতে সেসব কথাকে আড়ালে ফেলে দেন।

কিন্তু বড় বিতর্ক এবার ওঠে বাংলাদেশের বাছাইপর্ব চলাকালে দ্বিতীয় ম্যাচে তাসকিন আহমেদ ও আরাফাত সানির বোলিং অ্যাকশন সন্দেহজনক বলে আম্পায়াররা রিপোর্ট করলে। তাসকিন ও সানি এক বছর ধরে বল করে এলেও বিশ্বকাপের মতো গুরুত্বপূর্ণ আসর চলাকালে এই রিপোর্ট ক্ষুব্ধ করে টাইগার সমর্থকদের। এই খেলার মধ্যেই তাসকিন-সানির পরীক্ষা ও তার ফল পরবর্তী পদক্ষেপে আরও ক্ষোভে ফেটে পড়েন বাংলাদেশি ক্রিকেটপ্রেমীরা। বিশেষত তাসকিনের বিরুদ্ধে রিপোর্ট থেকে শুরু করে তার পরীক্ষা পদ্ধতি ও ফল পরবর্তী পদক্ষেপ সরাসরি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তাসকিন-সানিকে নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ দলকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিতে আইসিসির এ পদক্ষেপকে ‘ষড়যন্ত্রের ছক’ হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। আর এই ষড়যন্ত্রের অভিযোগ বরাবরের মতো তোলা হয় ভারতের বিরুদ্ধে, যে ভারতের টিভি চ্যানেলের টকশোতে ‘তাসকিন-ধোনির মুণ্ডু’ কাণ্ডের পরিণতির হুমকি দেওয়া হয়; বলা হয়, ‘একদিন কি চাঁদনী, ফির আন্ধেরি রাত’, ‘কোড অব কন্ডাক্ট ভঙ্গের দায়ে বিসিবির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত আইসিসির’। যদিও তাসকিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির প্রশ্নে আপত্তি উঠে আসে কলকাতার একটি সংবাদমাধ্যমে।

বাংলাদেশের ওয়ানডে ও টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তিতে ভারত দারুণ সহযোগিতা করলেও এ পর্যন্ত কখনো টাইগারদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি দেশটিতে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এমন অবহেলার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশকে বীরেন্দর শেওয়াগদের ‘সাধারণ মানের’ দল বলে খাটো করা, রবিচন্দ্রন অশ্বিনদের টুইট করে বাংলাদেশের পরাজয় কামনা দু’পক্ষের মধ্যে ‘দূরত্ব’ বাড়িয়েছে আরও।

এখন যদি ক্রিকেটে ‘ভারত বিরোধিতা’র জায়গা ‘কাদের তৈরি’ করা বলে প্রশ্ন তোলা হয়, তার উত্তরে কি বিসিসিআই প্রভাবিত আইসিসিই অভিযুক্ত হবে না? তার উত্তরে কি অভিযোগের ‍আঙুল উঠবে না ভারতের কতিপয় ক্রিকেট-প্রশাসকের বিরুদ্ধে? যারা কেবল ‘বাণিজ্যের’ স্বার্থে ভারতকে টুর্নামেন্টে রাখতে ‘ছোট’ দলগুলোকে জালিয়াতি করে আসর ছাড়া করে দেন?

এক ক্রিকেট সমর্থকের ভাবনা, সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ে মুশফিকুর রহিম ফেসবুক ও টুইটারে পোস্টে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন বলে তার ‘স্পোর্টসম্যানশিপ’ নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। যেখানে খোদ আইসিসিই অভিযুক্ত, সেখানে তার স্পোর্টস অথবা স্পোর্টসম্যানশিপ শতভাগ বজায় থাকার প্রত্যাশা করা যায় কীভাবে? ‍আর আইসিসির বিরুদ্ধে যে কেবল বাংলাদেশি সমর্থকদের অভিযোগই ওঠে না, তা পদত্যাগের আগে সাফ করে বলে গেছেন ড্যারেল হারপার-স্টিভ বাকনরসহ অনেক তুখোড় অফিসিয়ালরাই।

বাংলাদেশ সময়: ১৯১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০১, ২০১৬
এসএস/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।