খুলনা থেকে ফিরে: ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি দারুণ টান সালমা খাতুনের। বোলিং-ব্যাটিংয়ে সমান তুখোড়।
দল গঠনের সময় প্রথম ব্যাচেই ছিলেন সালমা। প্রশিক্ষনের আওতায় এলেন ২০০৬ সালে। সেই শুরু, এর পর দীর্ঘ সময় নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ দলকে। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের মুকুটও পড়েছিলেন বেশ কিছু দিন। গত এক দশকে সালমা খাতুন এমন এক চেনা চরিত্র হয়ে উঠেছেন যে শুধু নিজের এলাকায় নন, দেশ ছাড়িয়ে বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে পরিচিতি।
বাংলাদেশ সফরে আসা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মুখে সাকিব আল হাসানের সঙ্গে সালমার নামটিও উচ্চারিত হয়েছিলো। এ পর্যন্ত আসতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবতীই মনে করেন এ ক্রিকেটার, `সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জানাই, আমি এ পর্যায়ে আসতে পেরেছি। ক্রিকেট থেকে অনেক কিছু পেয়েছি। অনেক সম্মান পেয়েছি। ’
রুপসা নদীর পাড়ে ছোট্ট একটি গ্রামে থ্রি-পিস পড়ে কোমড়ে ওড়না গুজে ক্রিকেট শুরু সালমার। শুরুর কথা বলতে গিয়ে চোখগুলো চকচক করছিল। চেহারায় সুখানুভূতির ছাপ স্পষ্ট, ‘খেলাটা শেখা নিজের উদ্যোগে, কেউ এসে শিখিয়ে দেয়নি। ক্রিকেটটা দেখতে যেমন পছন্দ করতাম, খেলতেও। গ্রামে তো তখন মেয়েরা খেলতো না। নারকেল গাছের ডাগরো দিয়ে খেলতাম টেনিস বল দিয়ে। যখন একটু ভালো খেলতে শুরু করি তখন মামারা বিভিন্ন জায়গায় খেলতে নিয়ে যেত। মামারা তখন ভালো লেভেলেই খেলতো। মামারা খেলা ছেড়ে দিল, আমি ধরে রাখলাম। মামাতো ভাই, এলাকার ছেলেরা আছে ওদের সাথে খেলতাম। ওরাই উৎসাহ দিত, খেলতে গেলে ডেকে নিয়ে যেত। এভাবেই শুরু। ’
২০০৬ সালের শেষের দিকে যখন নারী ক্রিকেট টিম গঠনের জন্য খুলনায় অনুশীলন শুরু হলো, সালমা তখন দাদা বাড়ি গোপালগঞ্জে। ক্রিকেট টিম গঠন হবে, খুলনায় অনুশীলন শুরু হয়েছে শুনে পরদিনই ফিরে এলেন, ‘শুনতে পাই বাংলাদেশ ওমেন্স ক্রিকেট টিম হচ্ছে। প্রথমে খুলনায় একটা জেলা টিম করা হবে। তখন শেখ সালাউদ্দিন স্যার ছিলেন, ইমতিয়াজ আহমেদ পিলু স্যার, শঙ্কর স্যার-এরা মিলে টিম করছেন। তখন আমি দাদি বাড়ি গোপালগঞ্জে। খবর পেয়ে চলে আসি। ’
কোচদের অধীনে খুলনায় তখন জাহানারা, শুকতারা, বৈশাখী, আইরিনরা অনুশীলন শুরু করেছেন। প্র্যাকটিস ক্যাম্প এক সপ্তাহ অতিবাহিত হলে যোগ দেন সালমা, ‘মামাতো ভাই আমাকে মাঠে নিয়ে যায়। আমি বাড়িতে থ্রি-পিস পড়ে খেলতাম। ট্রাউসার, জার্সি পড়তাম না। জেলা স্টেডিয়ামে থ্রি-পিস পরেই আসি। এসে দেখছি সবাই প্র্যাকটিস করছে। প্রয়াত সালাউদ্দিন স্যার বললেন তুমি ব্যাটিং করো না বোলিং। আমি বললাম, দুটোই পারি। স্পিন না পেস, বললাম দুটোই করতে পারি। ওড়নাটা বেধে তিনটা স্পিন, তিনটা পেস বল করলাম। স্যার দেখে বললেন, তুমি স্পিন করো। স্যারের উৎসাহেই স্পিনার হয়ে উঠি। ’
এর পর ধীরে ধীরে নেতৃত্বগুনে বাংলাদেশ দলকে অনেক উপরে টেনে তোলেন সালমা। ২০০৮ সালে তার নেতৃত্বে প্রথম সিরিজেই হংকংকে উড়িয়ে দেওয়া বাংলাদেশ পায় ওয়ানডে স্ট্যাটাস। ২০১১ সালে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে জয় দিয়েই তার অসাধারণ নেতৃত্বে ওয়ানডে ক্রিকেটে পথ চলার শুরু বাংলাদেশের। পরপর দুটি এশিয়ান গেমসেও রুপাজয়ী দলের অধিনায়ক সালমাই খেলেছেন বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস দুটো (৭৫ ও ৪৯)। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে নারী ক্রিকেটের প্রতিচ্ছবিই যেন হয়ে উঠেছেন সালমা।
সালমা যখন শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামের ইনডোরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন নেটে তখন ব্যাটিং-বোলিং অনুশীলন করছেন বেশ কয়েকজন কিশোরী। যারা কিনা বড় হয়ে সালমাই হতে চায়। নারী ক্রিকেটের রোল মডেল হতে পেরে আনন্দ যেন আরও বেড়ে যায় সালমার, ‘নতুনরা আমাদের দেখে প্র্যাকটিস করতে আসে, এটা অনেক ভালো লাগে। অনেকেই আমাকে ফোন করে আপু আমার মেয়েকে খেলতে দেব। কোথায় দিলে ভালো হয়। সবাই মূল্যয়ণ করে, সম্মান করে। একজন নারী হিসেবে খুব ভালো লাগে ব্যাপারগুলো। ’
বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট এতটা উপরে উঠবে কখনো ভাবেননি বলেও জানালেন সালমা, ‘বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট যে এতটা আগাবে আমাদের সময়ে এমন কেউই ভাবেনি। প্রথম দিকে যারা আসছে তাদের কারোরই স্বপ্ন ছিলো না একদিন নারী ক্রিকেট এ পর্যায়ে আসতে পারে। আমরা কখনো কল্পনাও করিনি বাংলাদেশে ওমেন্স টিম হবে। জানতাম কেবল ছেলেদের টিমটাই আছে। যখন শুনলাম এটা হবে। তখন স্বপ্ন দেখার শুরু হলো-জার্সি পড়ে খেলবো, বাংলাদেশ টিমের হয়ে খেলবো...। আমি আমার টার্গেট অনেকটাই পূরণ করে ফেলেছি। ’
নারী ক্রিকেটের অগ্রগতির পেছনে যে মানুষগুলো কাজ করে গেছেন, যাচ্ছেন তাদের অবদানের কথা স্মরণ করতে মোটেও ভুললেন না সালমা। বললেন, ‘নারী ক্রিকেটের অগ্রযাত্রায় কয়েকজনের অবদানের কথা না বললেই নয়। আমাদের বিভাগীয় কোচ আহমেদ ইমতিয়াজ পিলু তার বিরাট অবদান। তার কারণেই আমরা এখনো টিকে আছি। চাইবো আমি যতদিন খেলি সে ততদিন আমাদের সাথে থাকুক। প্রয়াত সালাউদ্দিন স্যারের অনেক অবদান। আমার বোলিংয়ে সেই বিভিন্ন ভ্যারিয়েশন শিখিয়েছে। এছাড়া শঙ্কর নামে একজন কোচ ছিলেন খুলনায় নারী ক্রিকেটের পথচলায় তারও অনেক অবদান। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৫ ঘণ্টা, ০৬ এপ্রিল, ২০১৬
এসকে/এমএমএস
** মাঠের মানুষ আব্দুস সাত্তার কচি
** জাতীয় দলে ফিরবেন, বিশ্বাস জিয়ার
** লক্ষ্যটা নিজের ভেতরেই রাখতে চান সোহান
** ‘মাশরাফি ভাইয়ের রুমেই বেশী আড্ডা হতো’
** আবু নাসের স্টেডিয়াম যেভাবে ‘লাকি ভেন্যু’ হলো
** ক্রিকেটভক্ত-ক্রিকেটারভক্ত মিম, আফরিদ
** বিশ্বকাপের ক্যাচ দুটি মনে রাখবেন সৌম্য
** ‘লাল-সবুজ’ বাড়ির বাসিন্দা সৌম্য
** সৌম্যর সুন্দরবন-ট্রিপ
** মাশরাফিতে মুগ্ধ মুস্তাফিজের বাবা
** মুস্তাফিজের বোলিংটাই কেবল পাল্টেছে
** ‘কাটার স্পেশালিস্ট’ এর শুরু এ মাঠেই
** গ্রামের বাড়িতে দুরন্ত মুস্তাফিজ
** ক্রিকেটাঙ্গনে দাপট দেখানো খুলনার পথে…