পুষ্টিবিদরা বলছেন, শুধু গর্ভকালীন অবস্থায়ই নয়, সন্তান প্রসবের পরে বেড়ে উঠার সময়ে শিশুর শরীরের গঠনের জন্য যে যে পুষ্টি প্রয়োজন সেগুলো পাচ্ছে কী না সেই বিষয়টি এড়িয়ে গেলে ক্রীড়াঙ্গণের জন্য আগামীর খেলোয়াড় গড়ে উঠতে পারবে না।
জন্মের পর থেকে ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর পুষ্টিহীনতাই তাকে আগামী দিনে ফিটনেস হীনতায় ভোগাবে যা তাঁর খেলোয়াড়সুলভ মেধা বিকাশে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে বলেই মত পুষ্টিবিদদের।
তারা বলেন, এখনকার খেলেয়াড়রা ফিটনেস সঙ্কটে ভুগছেন অতীতের ভুলের কারণে। আর এখনকার ভুল হয়ে থাকবে ভবিষ্যত ফিটনেসহীনতার কারণ।
সঠিক পুষ্টি নিয়ে বেড়ে উঠলে যে অদম্য গতিতে দেশকে সাফল্য এনে দিতে পারতো ঠিক সেভাবে সে এখনকার খেলোয়াড়রা পারছে না। অনেকেই সামান্য চোটে কাবু হয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেকেই একটুতেই চোট পেয়ে ছিটকে পড়ছেন। খেলায় চোট থাকবেই। সুতরাং চোটের সাথে যুদ্ধ করতে পারবে এমন খেলোয়াড় আমাদের তৈরি করতে হবে।
একথা অনস্বীকার্য যে ক্রীড়ায় বাংলাদেশ আজ বিশ্ব অঙ্গনে একটি বহুল উচ্চারিত নাম। ক্রিকেটে মাশরাফি-মুশফিকরা লাল-সবুজের দলকে যেমন দক্ষিণ এশিয়ার পরাশক্তির তালিকায় তুলে এনেছেন তেমনি ফুটবলেও মেয়েদের ধারাবাহিক সাফল্য বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়।
শুধু ফুটবল কিংবা ক্রিকেটই কেন? সাঁতারে মাহফুজা আক্তার শীলা, ভারোত্তোলনে মাবিয়ারা স্বর্ণ জিতে দেশকে যে বিরল সম্মান এনে দিচ্ছেন তাতে সেই দিন আর বশি দেরি নেই যে, এই বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের হাত ধরে আরও দুর্লভ এক একটি সাফল্য আসবে, যাতে করে গর্বিত হবে ৫৬ হাজার বর্গ মাইলের এই ভুখন্ড। বিশ্ব দরবারে পত পত করে উড়বে লাল-সবুজের গৌরবজ্জ্বল পতাকা।
তবে তার জন্য সত্যিকারের পুষ্টিমানসম্পন্ন ক্রীড়াবিদ আমাদের প্রয়োজন।
পুষ্টিবিদরা মত দিয়েছেন, বিষয়টি নিযে শুরু থেকে কাজ করতে করতে হবে। গভাবস্থা থেকেই সকল পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে।
মাঠে যখনই কোনও খেলা গড়ায় তখন আলোচনায় প্রধান হয়ে উঠৈ আসে এই ফিটনেস প্রসঙ্গ। কেননা, ফিটনেস লেভেল একেবারে আপ টু দ্য মার্ক নয় বলেই আজ ছেলেদের ফুটবলের এই দৈন্য দশা। ৯০ মিনিট টানা একতালে খেলার দম তারা পান না। হাঁপিয়ে উঠেন, যা বিশ্বের অন্যান্য ফুটবল খেলুড়ে দেশে নেই।
ক্রিকেটে ফিটনেস সমস্যা অতটা প্রকট নয়। তারপরেও একথা বলা যাবে না যে লাল-সবুজের ক্রিকেটাররা সবাই দুর্দান্ত ফিটনেস নিয়ে জাতীয় দলে খেলছেন।
অ্যাথলেটিকসে বিষয়টি আরও হতাশার। সাফ গেমস, এশিয়ান গেমস অথবা অলিম্পিকের আসর-প্রতিটিতেই ব্যর্থতার গল্প। কিং স্প্রিন্ট, কি লং জাম্প, হাই জাম্প, পোলভোল্ট কিংবা বর্ষা নিক্ষেপ বিশ্ব আসরের এই প্রতিযোগিতাগুলোতে হিটেই বাদ পড়ে যায় লাল-সবুজের অ্যাথলেটরা।
বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের ফিটনেসের এমন দৈন্য দশার কারণ হিসেবে পুষ্টি হীনতাকেই দায়ী করেন সবাই।
বাংলানিউজের কথা হচ্ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিউটের পরিচালক প্রফেসর ডঃ নাজমা শাহীনের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত করেই বলতে চাই এই খেলোয়াড়রা যথাযথ পুষ্টি মানের জীবন যাপন করেন নি। গর্ভাবস্থায় তাদের মায়েদের যে ধরণের খাবার খাওয়া উচিত ছিলো তা তারা খায়নি। জন্মের পরেও তাদের জীবন গড়ে ওঠেনি পুষ্টির হিসাব নিকাশে। আর সেটাই এই ফিটনেসহীনতার কারণ।
ড. নাজমা বলেন, বিষয়টি এমন নয় যে এ ধরণের খাবার কিনে খাবারের মত সামর্থ্য তাদের ছিলো না, মূলতঃ তাদের মধ্যে সচেতনতারই অভাব ছিল। অনেকের ক্ষেত্রে বিষয়টি ছিলো তারা জানতেনই না।
এই পুষ্টিবিদ ও শিক্ষক আরও বলেন, গর্ভকালীন সময়েতো আছেই প্রসবের পরে আরেকটা সময় হলো ছ’মাস, আমরা যে সময়টিকে ব্রেস্টফিডিংয়ের সময় বলি। একটি শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং তার পূর্নাঙ্গ শারীরিক গঠনের জন্য যে যে পুষ্টি উপাদান দরকার সেগুলো তার মায়ের দুধের মধ্যেই আছে। এই জাতীয় সচেতনাতাগুলো আমাদের দেশের মায়েদের মাঝে এখনো পুরোপুরিভাবে গড়ে ওঠা বাকি।
অথচ এই বাচ্চাদের মধ্যেই কেউ ক্রিকেটার, কেউ ফুটবলার, কেউ অ্যাথলেট হচ্ছেন। ফলে শরীরে ঘাটতি নিয়েই তারা এগুলো করতে নেমেছেন। আর তাতে যা হবার তাই হচ্ছে, বলেন এই ঢাবি শিক্ষক।
তিনি বলেন, ছোট বেলা থেকে ১৩ বছর পর্যন্ত যে পুষ্টি ঘাটতি ছিল সেটি কিন্তু থেকেই গেছে যা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পরে আর কোনও পথেই পূরণ সম্ভব না।
নাজমা শাহীন যোগ করেন, ‘বিদেশি খেলোয়াড়দের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে তাদের শারীরিক গঠন অনুযায়ী যত লম্বা সময় তারা টানা খেলে যেতে পারে বা যে পরিমান শক্তি তাদের থাকে সেটা আমাদের খেলোয়াড়দের থাকছে না। আর তারা তখন স্রেফ মনের জোরে খেলতে চায়। এমন অবস্থায় শরীরের শক্তির হারিয়েও যখন খেলতে থাকে তখন ইনিজুরিতে পড়ে।
এই সঙ্কট থেকে উত্তোরণের উপায় কি? বাংলানিউজের এমন প্রশ্নের উত্তরে এই পুষ্টিবিদ বলেন, ‘সন্তান ক্রিকেটার, ফুটবলার বা অ্যাথলেট হবে এমন চিন্তা নিয়ে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তান জন্ম দেন না কিংবা বড়ও করেন না। বড় হলে শিশু কী হবে সেটা বড় হলেই নির্ধারিত হয়। সুতরাং আমাদের আসলে সকল শিশুকেই পুষ্টিমানে সঠিকভাবে জন্মদান ও বড় করে তুলতে হবে। তাদের মধ্য থেকেই কেউ কেউ খেলোয়াড় হবে। তখন তারা আর ফিটনেস সঙ্কটে পড়বে না।
ক্রীড়ায় দেশকে আরও সমৃদ্ধ করতে এবং গৌরবোজ্জ্বল সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে এর কোন বিকল্প নেই বলেই মনে করেন এই পুষ্টিবিদ।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৭
এইচএল/এমএমকে