সাইফউদ্দিন সম্ভাবনায়ম ও প্রতিভাবান অলরাউন্ডার। বছর খানেক ধরে নিজের যোগ্যতা, সামর্থ্যের মাধ্যমে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিচ্ছেন।
সর্বশেষ ত্রিদেশীয় সিরিজে সাইফউদ্দিনের পারফরম্যান্স ছিল অসাধারণ। বল হাতে প্রতিপক্ষের শিবিরে ত্রাস ছড়িয়েছেন। শেষ দিকে ব্যাটিং করে দুই ম্যাচে অপরাজিত ছিলেন। প্রথম ম্যাচে চার মেরে দলকে জয় এনে দিয়েছেন।
আফগানিস্তান ও জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজ শেষে একটা বিরতি চলছে। ভারত সিরিজের আগে জাতীয় দলের খেলা নেই দীর্ঘ দিন। দেশে জাতীয় লিগ শুরু হলেও সাইফউদ্দিন অংশ নিতে পারছেন না। এই উপলক্ষে ব্যস্ততা না থাকায় বাড়িতে কয়েকদিনের ছুটি কাটিয়ে আসেন তিনি।
সাইফউদ্দিনের বেড়ে ওঠার শহর ফেনী। ফেনীর বিভিন্ন মাঠে কেটেছে তার স্বর্ণালি শৈশব ও বর্ণালি কৈশোর। এসব মাঠের প্রতি সাইফের ভালোবাসা-টান অভাবনীয়, দুর্দমনীয়। ফেনীতে ছুটি কাটাতে এলে, এসব মাঠে তাকে একবার ঢুঁ মারতেই হয়। অবশ্য সাইফের বড় গুণ হলো, ছুটির সময়টি তিনি অনুশীলনহীন অলসভাবে ব্যয় করেন না। সুযোগ পেলে নেমে পড়েন ব্যাট-বল ও প্যাড নিয়ে।
ফেনীতে সাইফের অনুশীলনের জন্য প্রিয় জায়গা ফেনী পাইলট হাই স্কুল মাঠ, যেটি কলেজ মাঠ বলেও পরিচিত। এখানে অনুশীলনের যতটুকু সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, তা কাজে লাগিয়ে ফিটনেস ধরে রাখার চেষ্টা করেন তিনি। বর্ষার মৌসুমে ছুটিতে এলেও এই মাঠে বৃষ্টিআর্দ্র পিচে তাকে ব্যাটিং করতে দেখা যায়।
কিন্তু এবার কলেজ মাঠে আগের সেই ভাঙাচোরা পিচ নেই। মাটি ফেলে মাঠ উঁচু করেছে কর্তৃপক্ষ। আর এতে ঢাকা পড়েছে সাইফের ‘অনুশীলন পিচ’। ফলে ফেনীতে কয়েকদিন ধরে অনুশীলনের সুযোগ পাচ্ছিলেন না সাইফউদ্দিন। সেজন্য আঁকুপাঁকু করছিল তার তনু-মন।
সোমবার (০৭ অক্টোবর) শেষ বিকেলে কলেজ মাঠে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় ফ্রেন্ডশিপ ক্রিকেট ক্লাবের উদ্যোগে নতুনভাবে পিচ ঢালাইয়ের কাজ চলছে। তত্ত্বাবধান করছে সাইফের প্রিয় ‘অপু ভাই’। সঙ্গে আছেন ক্লাবের আরও কয়েকজন কর্মকর্তা। শরীফুল ইসলাম অপু (তিনি এই ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক) জানালেন, অনুশীলন করতে না পেরে ও (সাইফ) পুরো অস্থির হয়ে উঠেছে। আজ ঢালাইয়ের কাজ শেষ হলো, কালই সে অনুশীলনে নেমে পড়বে। ’
একটু পরের দৃশ্য। কলেজ মাঠের পূর্ব পাশের লাইন ধরে বসে আছে বিভিন্ন বয়সের মানুষ। বিশেষ করে প্রায় সবাই তরুণ-যুবা। তাদের সঙ্গে একই লাইনে বসে আছেন সাইফউদ্দিন, শরীফুল ইসলাম অপু ও সাইফউদ্দিনের পরিচিত অন্যরা। সাইফের স্বাভাবিক বচন-বসনে তাকে ভিন্ন রকম লাগছে। অনেকে তার দিকে তাকিয়ে ঔৎসুক্য ভরে চেয়ে আছেন। তাদের কপালে ভাবনার ভাঁজ—‘একি সাইফউদ্দিন নাকি অন্য কেউ’।
তবে যারা পরখ করে চিনতে পারছেন, তারা এসে সাইফের সঙ্গে কথা বলছেন। পাশে বসে ছবি তুলছেন। কেউ কথা বলতে চাইলে সাইফউদ্দিনও স্বাভাবিক ছন্দে ও অন্তরঙ্গতার মিশেলে কথা বলছেন। কারো সঙ্গে আচরণ-উচ্চারণে ‘অতি ভাব’ ও ‘আদিখ্যেতা’ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি তাকে।
হঠাৎ দেখা গেলো, আট-দশ বছর বয়সী একটি ছেলে। গায়ে পাঞ্জাবি-টুপি; ঠোঁটে দৃপ্ত হাসির রেখা। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে বালকটি সাইফউদ্দিনের দিকে অপলক নেত্রে চেয়ে রইলো। একটু আড়ষ্টতা, কিছু সংকোচ কাজ করছে চেহারাবয়বে। কে যেন সাইফকে বললেন, ‘ও প্রায় সময় তোমার কথা জিজ্ঞেস করে। ’ সঙ্গে সঙ্গে সাইফ ছেলেটিকে কাছে ডাকলেন। কুশল বিনিয়ম করলেন। কোথায় পড়ে জানতে চাইলেন। কোরআন হিফজ মাদরাসায় পড়ে শুনে, কয় পারা মুখস্ত করেছে জিজ্ঞেস করলেন। বাড়ি-ঘর ও পরিবার সম্পর্কেও প্রশ্ন করলেন। সাইফউদ্দিনের এমন হৃদ্যতা ও সপ্রতিভ আচরণে তখন বালকটির চোখে-মুখে মুগ্ধতার দীপ্তি।
এর মাঝে একটা ছোট ছেলে এলো, চা-বিস্কুট আর কেটলি নিয়ে। সাইফ ছেলেটিকে দাঁড় করালেন। নিজে চা খেলেন, অন্যকে খাওয়ালেন। চা খাওয়ার মাঝ পথেই ছোট এক বালক এসে সাইফের হাতে একটি বল-ব্যাট দিলো। সাইফউদ্দিনকে বললো তাদের সঙ্গে খেলতে।
গোধূলী বেলা তখন, সূর্য দিগন্তের ওপারে যাওয়ার প্রস্তুতি প্রায় শেষ। তখন খেলা সম্ভব নয়। হয়তো সামান্য ব্যাটিং বা বোলিং হতে পারে। তাই সাইফউদ্দিন বললেন, ‘ঠিক আছে তাহলে ক্যাচ প্র্যাকটিস হতে পারে, তবে শর্তসাপেক্ষে। ’
সাইফউদ্দিন এক হাতে বল নিলেন। অন্য হাতে ব্যাট ধরলেন। এরপর বলটাকে ডানহাতে ছুড়লেন সামান্য শূন্যে। আর বাঁ-হাতের ব্যাটে সজোরো হাঁকিয়ে পাঠিয়ে দেন আকাশের ঠিকানায়। অন্যদিকে দূরে দাঁড়িয়ে আছে, ছোট ছোট বেশ কয়েকজন সাইফ-ভক্ত। বলটি নিচে নেমে এলেই তারা ক্যাচ নেবে, এই আশা-উচ্ছ্বাসে তারা অপেক্ষমান। এভাবে বেশ কিছু ক্যাচ পাঠালেন সাইফ। প্রায় ক্যাচই মিস করেছে ক্ষুদে ভক্তরা। কিন্তু হঠাৎ যদি কোনো বল কারো হাতে আটকা পড়ে, চিৎকার-উল্লাস। সাইফউদ্দিনের চেহারা-বদনেও দ্যূতি ছড়ায় চওড়া হাসির পালক। কিন্তু সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় ম্রিয়মাণ আলোতে বল গায়ে পড়লে ছোটরা ব্যথা পাবে, এই আশঙ্কায় সাইফউদ্দিন ক্যাচ ক্যাচ খেলা বন্ধ করে দেন।
এরপর সবাই জড়ো হয়ে সাইফউদ্দিনের কাছে জটলা বেঁধে দাঁড়ায়। তার সঙ্গে কথা বলে, একটু-আধটু দুষ্টমিও করে। সাইফউদ্দিনকে এমন স্বাভাবিকতায় পেয়ে তারা আনন্দ-উজ্জীবিত হয়। তার সহজতা ও সাহচর্যে প্রাণিত হয়।
কিন্তু এরই মধ্যে শুরু হয়েছে মাগরিবের আজান। সাইফের এখন ফেরার তাড়া। চটজলদি বাসায় ফিরতে হবে। ফ্রেশ হয়ে মাগরিবের নামাজ আদায় করতে হবে। এই মুহূর্তে সাইফউদ্দিনের ভেতর খুব তৎপরতা ও চঞ্চলতা দেখা গেলো।
খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আছে নীল রঙের একটি মোটরবাইক। সাইফউদ্দিন গিয়ে সেটিতে চেপে বসলেন। কেউ একজন চালকের আসনে, সাইফ বসেছেন তার পেছনে।
সাইফউদ্দিন ফিরে গেলেন। কিন্তু ক্ষুদে ভক্ত ও অন্যদের জন্য রেখে গেলেন একরাশ মুগ্ধতা ও ভালোবাসার আরক। দেশের ক্রিকেটে সাইফের প্রতি এই মুগ্ধতা ও ভালোবাসা টিকে থাকুক যুগ যুগ ধরে। স্নিগ্ধ-মোহন ও দেদীপ্যমান নতুন ভোরের অনির্বাণ প্রত্যাশা হয়ে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৯
এমএমইউ/এমএমএস