ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

বিউটি অব টেস্ট ক্রিকেট ও একটি রোমাঞ্চকর অপেক্ষা

মাহমুদুল হাসান বাপ্পি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, স্পোর্টস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৫ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০২২
বিউটি অব টেস্ট ক্রিকেট ও একটি রোমাঞ্চকর অপেক্ষা

‘দিস ইজ দ্য বিউটি অব টেস্ট ক্রিকেট’ ভারতের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক জাসপ্রিত বুমরাহ বলেন এমন। ম্যাচটা তার জন্য ছিল স্বপ্নের মতো, রোহিত শর্মার বদলে নেতৃত্বটা ওঠেছিল এই পেসারের কাঁধে।

কত কত দিন পর বোলারের হাতে ভারতের অধিনায়কত্ব!

ম্যাচের তিনদিন অবধি সব ঠিকঠাকই চলছিল, সিরিজের ট্রফিটা তার হাতে; এমন কল্পনায় ভেসে বুমরাহর প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার কথা তখন। অথচ এরপর চোখের সামনে তিনি হতে দেখলেন একটা ‘বিপ্লব’, ম্যাচ হেরেও তার হতাশার চেয়ে বেশি তাই মুগ্ধতা!

জো রুট- খানিক আগেই ‘বিপ্লবের নেতা’ হয়েছেন যিনি, তার চোখেমুখে তৃপ্তি। তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে আবার বাচ্চা হয়ে গেছি, এটা দারুণ। যখন প্রথম খেলা শুরু করেছিলাম, ঠিক তখনকার মতো অনুভূতি হচ্ছে। ’ সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া প্রথম উত্তরেই রুট সারাংশ করে দেন সবকিছুর। রিভার্স স্কুপেরও? ওই উত্তরটা অবশ্য দেওয়া কঠিন!

বিপ্লবের কারিগরদের একজন বেন স্টোকস। যখন ইংল্যান্ডের অধিনায়কত্ব পেলেন ১৮ ম্যাচের কেবল একটিতে জিতেছে তার দল। দায়িত্ব নেওয়ার পর? চারটিতে জিতল ২৭৭, ২৯৯, ২৯৬ ও ৩৭৮ রান তাড়া করে। মন্ত্রটা কী? স্টোকস চান তার সতীর্থরা হবেন ‘রকস্টার’ অথবা ‘ইন্টারটেইনার’।

বব ডিলান কিংবা এলটন জনের মতো? স্টোকস ভালো বলতে পারবেন সেটা। ভারতের বিপক্ষে সিরিজ বাঁচানোর আগে ‘রুট, আমরা আসলে কী?’ জানতে চেয়েছিলেন স্টোকস। রুটের জবাব কী ছিল? ‘রকস্টার’!

১৪২ রানের ইনিংস খেলে অবিশ্বাস্য কাণ্ডটা ঘটিয়ে ফেরার পর রুট অবশ্য স্বীকার করেন, ‘আমার কখনও মনে হয়নি নিজেকে রকস্টারের মতো দেখতে বা নিজের মধ্যে ওরকম অনুভূতি হবে’ এরপর তিনি বলেন, ‘কিন্তু ১০ সেকেন্ডের জন্য, আমি হয়তো আজকে এটা হয়েছি। ’

স্টোকসের দল ৩৭৮ রান করতে চেয়ে এবং পরে করে আসলে কী দেখাতে চেয়েছিল? স্টোকস জবাব দেন তার, ‘আমরা কীভাবে খেলব, এতে প্রতিপক্ষকে মনোযোগ দিতে হবে। আর এটা নিয়ে তারা থাকবে চিন্তায়। ’ 

ম্যাককালামকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আসলে দলের ভেতর আবহটা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন, টেস্ট ক্রিকেট আরেকটু ক্যাজুয়াল, অনেক ক্রিকেটারের প্রতি নিজের বিশ্বাস রেখেছেন, দল  ও দলের বাইরে যারা বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল ‘সিরিয়াসনেসের’ ভারে। স্টোকস-ম্যাককালাম জানতেন, ব্যাপারটা সহজ নয়। ছোটবেলা থেকে এই দলের অনেকেই টেস্ট খেলার স্বপ্ন দেখে বেড়ে ওঠেছেন, তাদের কাছে ব্যাপারটা সিরিয়াস। তারা তাই বললেন, ‘স্মার্ট ক্যাজুয়াল’ হও।

এভাবে টেস্ট খেলা হয় না। হেঁটে হেঁটে এসে মোহাম্মদ শামিকে তার প্রথম ওভারেই মিডউইকেটের ওপর দিয়ে মারা উচিত না। আপনার রান ১২০ হলেও, শার্দুল ঠাকুরকে রিভার্স স্কুপ করে ছক্কা হাঁকানোর চেষ্টা করা ঠিক না।

ঋষভ পন্থ সেঞ্চুরি করে ফেলার পর তার জন্য তিনটা স্লিপ রাখার মানে হয় না। প্রথম ইনিংসে ১৩২ রানে পিছিয়ে থাকার পর ভারতকে টেস্টে হারানো সম্ভব না। এবং অবশ্যই অবশ্যই ভারতের এই বোলিং লাইন-আপের বিপক্ষে এমন পিচে অ্যাটাক করে ৩৭৮ রান তাড়া করতে যাওয়া যথার্থ না।

এমন অনেক ‘না’ এজবাস্টনের চারপাশে চারদিনে ধরে শুনে থাকতে পারেন আপনি কিংবা রেডিও কমেন্ট্রিতে। ‘বাজবলের’ মন্ত্র জঁপে দেওয়া ব্রেন্ডন ম্যাককালামের দলের তাতে বয়েই গেছে। এজবাস্টনে কখনো ৩৭৮ রান তাড়া করতে পারেনি কেউ, ইংল্যান্ড তাদের শত বছর পাড় হওয়া ইতিহাসে কখনোই না। তাতেও কোনো কিছুই যায়-আসে না।

ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটার আগেও ১০৫১টা টেস্ট খেলেছিল ইংল্যান্ড, জয় এসেছিল ৩২৫টাতে। চতুর্থ ইনিংসে প্রথম রান তাড়া করে জয় এসেছিল সেই ১৯২৮ সালে। মেলবোর্নে তিনদিনে ধরে গড়া তোলা ওই শেষ ইনিংসে সাড়ে ছয় ঘণ্টা ব্যাট করেছিলেন হারবার্ট স্যাটক্লিফে। তবুও জয়টা ছিল কেবল ৩ উইকেটে!

এজবাস্টনের আগে সবচেয়ে বড় রান তাড়া করে জয়টা কবে এসেছিল, মনে থাকার কথা আপনার। এখনকার অধিনায়ক বেন স্টোকস অতিমানব হয়ে গেছিলেন যেদিন, এগারো নম্বর ব্যাটারের চেয়ে একটু বেশি কিছু হতে হয়েছিল জ্যাক লিচকেও।

ম্যাচের শেষ ঘণ্টায় কেবল একটা উইকেট হাতে রেখেই হেডিংলিতে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল ইংল্যান্ড। ওই ম্যাচটা যে ক'জন খুব কাছ থেকে দেখেছেন, জনি বেয়ারস্টো অথবা জো রুট তাদের অন্যতম। রুট আর বেয়ারস্টো একে অপরকে কতটা চেনেন সেটাও জানা থাকা দরকার আপনার।

এই দুজন কাউন্টিতে অনূর্ধ্ব-১২ দলের হয়ে ম্যাচ খেলেছিলেন একসঙ্গে, ২০০২ সালে। রুট বয়সে ছোট ছিলেন, কিন্তু কোচ জানতেন তিনি বড় খেলোয়াড়; তাই খেলতে হতো দুই-তিন বছরের বড়দের সঙ্গে।

রুট-বেয়ারস্টো দুজনেই ইয়র্কশায়ারে বেড়ে ওঠেছেন, একে-অপরকে চেনেন সেই ছোট্টবেলা থেকে। দুজনের হাতে এজবাস্টনে লেখা হলো একটা ‘রেভ্যুলেশন’। রুট-বেয়ারস্টো সেঞ্চুরি করলেন। শেষ ইনিংসে ইংল্যান্ড তাড়া করল ৩৭৮ রান, ৭ উইকেট আর অনেক অনেক বল হাতে রেখে!

অনেকদিন ধরে ভুগতে থাকা ইংল্যান্ডের উদ্বোধনী জুটি সেঞ্চুরি ছাড়াল এই পথে। জ্যাক ক্রলি আর লিস যোগ করলেন ১০৭ রান, কেবল ১৯ ওভার ৫ বলে। বলার অপেক্ষা রাখে না ইংল্যান্ডের হয়ে এটাই উদ্বোধনী জুটিতে দ্রুততম শতক।

১০ ওভারেই তারা ৫০ করেছিলেন, ২০১২ সালের পর ইংল্যান্ড এই প্রথম দেখেছে এমন দৃশ্য। সেবার অবশ্য কেবল ৫৭ রান তাড়া করতে নেমেছিলেন অ্যালিস্টার কুক ও নিক ক্যাম্পটন। এবার ক্রলি- লিস ৩৭৮!

স্টোকস-ম্যাককালাম জুটির ‘নতুন থিউরি’ সফল হবে কি না, প্রশ্ন আছে এ নিয়ে। উপমহাদেশেও একই ধাঁচের ক্রিকেট চলবে কি না, শঙ্কা থেকে যাচ্ছে অনেক। চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করতে না পারলে ইংল্যান্ডের পরিকল্পনা কেমন হবে, জানা যায়নি তার উত্তর। তবে ইংলিশদের অবস্থানটা পরিষ্কার।

স্টোকস যেমন বলেন, ‘ইংল্যান্ডের টেস্ট ক্রিকেটকে নতুন করে লিখতে চাই’। আত্মবিশ্বাসকে সঙ্গী করে জানান ‘‘কখনো হয়তো অন্য দলগুলো আমাদের চেয়ে ‘বেটার’ হবে, কিন্তু কখনোই ‘ব্রেভ’ হতে পারবে না। ’’ এমন কিছুর পর বুমরাহর মতো ‘দিস ইজ দ্য বিউটি অব টেস্ট’ বলে রোমাঞ্চ নিয়ে অপেক্ষা ছাড়া কীইবা আর করার থাকতে পারে!

বাংলাদেশ সময় : ১১২৫, জুলাই ৬, ২০২২
এমএইচবি
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।