কলকাতা: ভারতের উত্তরাখণ্ডের যোশীমঠে সাম্প্রতিক ভূমিধসের পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে প্রকৃতির কাছে কতটা অসহায় মানুষ। তীব্র ঠান্ডা এবং আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে সেখানকার শত শত পরিবার।
এমন অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের শৈল শহর দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং ও পশ্চিম বর্ধমান জেলার কয়লাখনি অঞ্চল রানিগঞ্জ কতটা নিরাপদ- এ নিয়ে রাজ্যজুড়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ি এলাকায় যেমন লাগামহীন অবৈধ নির্মাণ বাড়ছে, ঠিক তেমনি রানিগঞ্জ কয়লা খনি থেকে বেআইনিভাবে অনেক পরিমাণে কয়লা উত্তোলন চলছে।
পাহাড়ে বড় নির্মাণ সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে অনুমোদিত নির্মাণ উচ্চতার সীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠছে। পশ্চিমবঙ্গ মিউনিসিপাল আইন অনুসারে, পাহাড়ের যেকোনো নির্মাণ ১১ দশমিক ৫ মিটারের বেশি হওয়া উচিত নয়। তাবে সরকারি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ১৩ মিটার পর্যন্ত উচ্চতা বাড়ানো যেতে পারে। অভিযোগ এই নিষেধাজ্ঞা শুধু কাগজে-কলমে।
সম্প্রতি কালিম্পং, কার্শিয়াং ও দার্জিলিং অঞ্চল সম্পর্কে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া একটি প্রতিবেদনে দাবি করেছে, প্রায় ১৭ শতাংশ এলাকা তীব্র ভূমিধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। আর ৪০ শতাংশ এলাকায় মাঝারি ভূমিধসের ঝুঁকি রয়েছে। শুধুমাত্র ৪৩ শতাংশ এলাকাকে হালকা ভূমিধস প্রবণ এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ভারী ভূমিধস এলাকা হিসেবে যেসব অঞ্চল চিহ্নিত করা হয়েছে, সেসব অংশেই বড় কংক্রিটের নির্মাণ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শৈল শহরে যদি জোশীমঠের মতো ভূমিধসের ঘটনা ঘটে, তবে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ উত্তরাখণ্ডের চেয়ে কয়েকগুণ বাড়বে।
প্রকৃতির ওপর অত্যধিক নির্মাণ কতটা ভয়ংকর পরিস্থিতি হতে পারে, তা এখন দেখছে জোশীমঠবাসী। সেখানে এখন সরকারিভাবে ভাঙা হচ্ছে বাড়ি ও হোটেল। পরিবেশবিদ ও ভূতাত্ত্বিকদের মতে, পাহাড়ে মাটির গঠন অত্যন্ত আলগা হয়। ফলে ভূমিকম্প বা বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও যথেষ্ট ঝুঁকি থাকে। দার্জিলিঙে অতিরিক্ত নির্মাণ বড় ক্ষতি ডেকে আনবে। দুর্ভাগ্যজনক হলো, বড়বড় নির্মাণ সংস্থাগুলো প্রশাসন-রাজনীতিবিদদের যোগসাজশের কারণে ভবনের উচ্চতার সীমা প্রায়শই লঙ্ঘন করে চলছে। এতে শৈল শহরকে ভয়ংকর বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের মত, অবৈধ নির্মাণ ছাড়া তিস্তা নদীর ওপর বাঁধ ও সেবক-রংপো রেল প্রকল্পের নির্মাণ কাজে মাটির চাপ বাড়ছে। তাদের মতে সমগ্র পূর্ব হিমালয় অঞ্চলের মাটি দুর্বল। ফলে জোশীমঠের মতোই দার্জিলিং কালিম্পং, কার্শিয়াঙেও একই রকম সতর্কবার্তা প্রযোজ্য।
একই পরিস্থিতি হতে পারে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান জেলার কয়লাখনি অঞ্চল রানিগঞ্জেও। মঙ্গলবার (১৭ জানুয়ারি) এমনই আশঙ্কা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার থেকে খনি অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় মাটিতে ফাটল, ধোঁয়া বেরোচ্ছে অনর্গল।
ইস্টার্ন কোলফিল্ড লিমিটেড কর্তাদের ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয় বাসিন্দারা। বাড়ছে আতঙ্ক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে রয়েছে যোশীমঠ। একই অবস্থা রানিগঞ্জে। গত ১০ বছর ধরে এ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আমরা লড়াই করছি। যে অর্থ দেওয়ার কথা ছিল, কিছুই দেয়নি। যদি আমরা ঘর বানিয়ে না দিই, ধস নামলে ২০ হাজার মানুষ মরে যেতে পারে। আজ পর্যন্ত কোনো অর্থই বরাদ্দ করেনি কেন্দ্র সরকার।
রানিগঞ্জ ধসপ্রবণ এলাকা। বেআইনি ভাবে প্রচুর কয়লা উত্তোলন হচ্ছে এই অঞ্চল থেকে। কয়েক দশক ধরে এই প্রথা চলে আসছে। সেই প্রথা পুরোপুরি বন্ধ না হলে সমূহ বিপদ বাড়তে থাকবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, অবৈধ খনন বন্ধ হয়নি এখনও। বাড়িতে যখন তখন ফাটল দেখা দিচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় মাটি সরে গিয়ে বেরোচ্ছে বিষাক্ত মিথেন গ্যাস। পরিস্থিতি এমনই যে, নিজের এলাকায় মানুষের যাতায়াত কার্যত বন্ধ। ‘বিপজ্জনক’ লেখা বোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। মোতায়েন রয়েছে পুলিশ।
তবে অবৈধ কয়লা পাচার বারবার নাম জড়িয়েছে মমতার দলের সঙ্গে। রানিগঞ্জের পরিস্থিতি নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে স্বর চড়িয়ে বিজেপি সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষের মত, মানুষের তৈরি করা বিপদ; কেন্দ্র সরকার কী করবে? কয়লা চুরির জন্য তো মোদি দায়ী নন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০২৩
ভিএস/আরএইচ