ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

মমতাই দায়ী!

জেসমিন পাপড়ি, ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৪ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৪
মমতাই দায়ী!

কলকাতা থেকে: ভারতের ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহ শুরু করেছিলাম পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা থেকে। নির্বাচন শেষে ইভিএমএ ঝড় তুলে বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদী যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসনে দিকে ধাবমান তখন আমি দিল্লি থেকে ফেরার পথে।



একই পথ। আবারও পশ্চিমবঙ্গ। সেই রাজ্য যেখানে মমতা তাণ্ডবেও মোদীর বিজেপি রেকর্ড সংখ্যক ভোট পেয়েছে। মোট ভোটের ১৭ শতাংশ। অথচ ২০০৯ সালে তারা পেয়েছিল মাত্র ৬ শতাংশ ভোট। এবার এই ১১ শতাংশ ভোট বাড়ার জন্য মোদী হাওয়ার পাশাপাশি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের কর্ণধার মমতা ব্যানার্জিকেই দুষছেন পশ্চিমবঙ্গবাসী। শহরের বিভিন্ন পর‌্যায়ের আলাপচারিতায় তেমন আভাসই মিলেছে।

পশ্চিমবঙ্গ থেকে এবার দু’টি আসন জুটেছে ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপির। স্থানীয়রা বলছেন, মমতা ব্যানার্জির কারণেই মানুষ বাধ্য হয়ে এবার বিজেপির পদ্মফুলে ভোট দিয়েছেন। কারণ, তিনিই সংখ্যালঘু ভোট কেনার নামে মূলত পশ্চিমবঙ্গকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন- হিন্দু আর মুসলিমে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ছাপ্পা (জাল) ভোট দিয়ে ভোটারদের বঞ্চিত করার অভিযোগও আছে।

কলকাতার মার্কুইজ স্ট্রিটে বসে আলাপের সময় কিছুতেই মাথায় ঢুকছিল না কীভাবে মমতা ব্যানার্জি বিজেপির ভোট বাড়ালেন। সেলিম নামে একজন দোকানদার বললেন, তিনি মুসলিম ভোট পাওয়ার আশায় হিন্দুদের বঞ্চিত করেছেন। সেটা অনেক হিন্দুই মেনে নিতে পারেননি। সেসব হিন্দুরা এবার তাদের ভোটটি বিজেপিকেই দিয়ে এসেছেন।

তিনি বলেন, পাশাপাশি দু’জন গরিব মুসলমান ও হিন্দুর বাসবাস। দুই বাড়ির দু’টি মেয়েই একসঙ্গে স্কুলে যায়। হঠাৎ একদিন মুসলমান বাড়ির মেয়েটি সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে একটি বাইসাইকেল পেল। এরপর থেকে সে সাইকেল চড়ে স্কুলে যায়। আর হিন্দু গরিব মেয়েটি যায় হেঁটে হেঁটে। তাহলে বলুন, কেন ওই হিন্দু বিজেপিকে ভোট দেবে না?

বিষয়টি নিয়ে আর একটু জানতে আলোচনা চালিয়ে গেলাম। কলকাতার অদূরে নদীয়া জেলার রানাঘাট মহকুমা। সেখানকার গাংনীপুর গ্রামের বাসিন্দা ঝন্টু মণ্ডল এ প্রতিবেদককে বলেন, মমতা ব্যানার্জি মুসলমান ভোট ব্যাংক বানাতে ইমাম ভাতা চালু করেছেন। যদি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইমামরা ভাতা পান, তাহলে রাজ্যের পুরোহিতরা কী অন্যায় করেছেন? এ প্রশ্ন রইল তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে। এভাবে মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের বঞ্চিত করেছেন। তার ফল হিসেবে বিজেপির ভোট বেড়েছে এ রাজ্যে।

এদিকে ফলাফল দেখে রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে নতুন শক্তি হিসেবে উঠে এলো বিজেপি। যার প্রভাব আগামী কলকাতা পুরসভা এবং ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

একই সুরে রানাঘাট রেলস্টেশনে বসে প্রশান্ত কুমার নামের একজন ব্যবসায়ী জানালেন, এমনিতেই রাজ্যে বিজেপির ভোট বেড়েছে। কেন্দ্রের সরকারেও এবার তারা। সুতরাং, সামনের পঞ্চায়েত ও বিধানসভা নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়বে।

কলকাতা আসার আগেও একই সুর শোনা গিয়েছিল দিল্লির রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কণ্ঠে। তারা বলেন, পশ্চিমবঙ্গকে মমতা ব্যানার্জি জটিল করে ফেলছেন। ভোট কেনার নামে তিনি মানুষের সম্প্রীতিতে আঘাত করেছেন।

মুসলমানদের প্রতি এই ‘আদিখ্যেতা’য় অখুশি নন হিন্দু সমাজ। তবে তাদের পাশাপাশি দরিদ্র শ্রেণির হিন্দুরাও যেন এসব সুবিধা পান, সেটাই দাবি তাদের। না হলে প্রত্যক্ষ পার্থক্য তারা মেনে নিতে পারেন না।

রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও প্রবীণ রাজনীতি বিশ্লেষক অশোক চট্টোপাধ্যায় কলকাতার মিনি বাংলাদেশখ্যাত মার্কুইজ স্ট্রিটে বসে বলেন, যেকোনো দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে এগিয়ে নিতে বিশেষ সুবিধা দেওয়া অন্যায় কিছু নয়। তবে সেটিকে ভোট ব্যাংক তৈরির কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা অন্যায়। এটা অন্যরা মেনে নেবেন না, এটাই স্বাভাবিক। ব্যালট কেনা অন্যায়ের জবাব তারা ব্যালটের মাধ্যমেই দেবেন।

এদিকে রাজ্যে বিজেপির উত্থানে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন খোদ মমতা ব্যানার্জি। মোদী হাওয়ায় যাতে আর কোনো নির্বাচনে রাজ্যবাসী না ভাসেন- সেজন্য সামনের পৌরসভা ভোটও পিছিয়ে দিতে চাইছেন তিনি। নির্বাচন কমিশন থেকে আগামী জুলাইয়ে ১৭টি পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তাগাদা দিয়ে চিঠি দিলেও মমতা ‘রা’ কাড়ছেন না। তিনি চাইছেন, বিজেপি সরকার পূর্ণভাবে দায়িত্ব নেওয়ার পরে হয়তো এই মোদী হাওয়া খানিকটা ম্লান হবে। ততোদিনে তিনিও নিজ দলের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করবেন। এজন্যই নির্বাচনের দিকে যেতে চাইছে না তার রাজ্য সরকার।

দিল্লির রাজনৈতিক সূত্রের খবর, বিজেপিও চাইছে, পশ্চিমবঙ্গের এ উত্থানকে ধরে রাখতে। যাতে আগামী বিধানসভা নির্বাচনেও রাজ্যে প্রভাব ফেলতে পারে তারা। শুধু তাই নয়, রাজ্যের উন্নয়নে মমতার রাজ্য সরকারের সহায়তা চাইবে কেন্দ্রীয় সরকার। যাতে মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছায়, বিজেপি এ রাজ্যে উন্নয়ন চায়।

এবারের লোকসভা নির্বাচনে গতবারের অর্জিত দার্জিলিং আসনটি ধরে রাখার পাশাপাশি আসানসোল আসনটিও তৃণমূলের দোলা সেনকে হারিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছেন বিজেপির বাবুল সুপ্রিয়৷

এবারের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে ৩৪টি পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস, চারটি আসন পেয়েছে জাতীয় কংগ্রেস এবং বিজেপি ও বামফ্রন্ট পেয়েছে দু’টি করে আসন।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৫ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।