ঢাকা: ঢাকাই মসলিন পুনরুদ্ধার হয়েছে। বর্তমানে একেকটি মসলিনের দাম পড়বে ৬ থেকে সাড়ে ১১ লাখ টাকা।
তিনি বলেন, ১৭০ বছরে পর সার্থক গবেষণার ফলে ঢাকাই মসলিন পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছে। এখন যদি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব না হয়, তাহলে এ গবেষণা সফল হবে না।
মঙ্গলবার (৬ মে) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পর্যটন করপোরেশন অডিটোরিয়াম মিলনাতনে তাঁতবোর্ড আয়োজিত ‘বাংলাদেশ সোনালী ঐতিহ্য মসলিনের সুতা ও কাপড় তৈরির প্রযুক্তি পুনরুদ্ধার এবং এখাতে উদোক্তাদের বিনিয়োগের সম্ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অথিতির বক্ত্যবে তিনি একথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, গবেষণা করে পুনরুদ্ধারের অর্থ হলো মানুষের কাছে পৌঁছানো। এ জন্য বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যেতে হবে। মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। মসলিনকে ফিরিয়ে এনে হৃত গৌরব উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠত্ব পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিলেন। এখন সহজলভ্যভাবে মানুষের পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে সেটা টেকসই করতে হবে।
তিনি বলেন, মসলিন যদি আমরা ব্যবহার উপযোগী করতে না পারি তাহলে এ গবেষণার মূল্য থাকবে না। গবেষকরা যে কাজটি করেছেন এটা আমাদের বাণিজ্যিকীকরণে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে। প্রাইভেট খাতে যদি ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হয় তাহলে তারা বিভিন্ন রকম ডিজাইন করতে পারবে, রপ্তানি করতে পারবে। এর ফলে দাম কমিয়ে আনতে পারবে। এটা করা গেলে আমরা জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারব।
রপ্তানিকারকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, তারা যদি রপ্তানির উদ্যোগ নেয়, তাহলে অতীতের মতো আবার মসলিন বিশ্ব জয় করতে পারবে। অতীতে যেমন বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তৈরি করেছিল। মোঘল মহারানী, ইংল্যান্ডের মহারানীরা মসলিন ব্যবহার করতেন। মসলিন আবার নতুন করে আলোড়ন তৈরি করবে।
মসলিনের জন্য বাংলাদেশেই বড় বাজার বলে মনে করেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী। তিনি বলেন, আজকের বাংলাদেশ আর সেই বাংলাদেশ নেই। বালাদেশের মানুষ অনেক এগিয়েছে, বাংলাদেশ আর গরিব না। অর্থের দিকে থেকে অনেক বলিয়ান হয়েছে, রোজগার বেড়েছে। এর ফলে মানুষের সক্ষমতার পাশাপাশি রুচি বদলেছে। মসলিন ফিরে এসেছে। যদি এর দাম আরও কমিয়ে আনতে পারি তাহলে বাংলাদেশেই মসলিন বড় বাজার পাবে।
ঢাকাই মসলিন আর জামদানিকে দুই বোন উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, এক বোন মসলিন হারিয়ে গিয়েছিল। এক বোন জামদানি ছিল। মসলিন পুনরুদ্ধারের মধ্য দিয়ে দুই বোনই আবার ফিরে এল।
ঢাকাই মসলিনে ফ্যাশন ডিজাইন করার জন্য তাগিদ দিয়ে মন্ত্রী বলেন, যদি ফ্যাশন ডিজানাইনার হাত দেন তাহলে দাম কমানোসহ বাজারজাত করার কাজটি সহজ হবে।
সরকার বাণিজ্যিকীকরণ করতে পারবে না উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, আমাদের একটি নমুনা আছে সরকার উদ্ভাবন করতে পারবে, স্যাম্পল করতে পারবে, গবেষণা করতে পারবে। কিন্তু বাণিজ্যিকীকরণ পারবে না। রাজশাহীতে আমাদের রেশম বোর্ডের একটি শোরুম আছে। মানুষে সেখানে যায় না। কিন্তু কাছেই বাজার থেকে শিল্পের শাড়ি কিনে আনেন। আমার মনে হয় আমাদের ডিজাইন ভাল না, আমাদের ডিজাইন আপনাদের পছন্দ হয় না। পাশেই মার্কেট থেকে সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের শাড়ি কিনে নিয়ে আসে। বেসরকারি খাতের মাধ্যমে যদি বাণিজ্যিকীকরণ করতে পারি তাহলে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব।
বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলে প্রতিযোগিতা বাড়বে, প্রতিযোগিতা বাড়লে দাম কমে আসবে। সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে। তখন মানুষের রুচি ও পছন্দের সঙ্গে ঢাকাই মসলিনে নতুন নতুন ডিজাইন ও ভিন্ন ধরনের পোশাক তৈরি হবে। এটা সম্ভব না হলে ১৭০ বছর পর ঢাকাই মসলিন ফিরে পেয়েছি। মানুষের নাগালের মধ্যে না রাখতে পারলে আবার হারিয়ে যাবে; এমন আশঙ্কা করেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী।
পুতুলের গায়ে মসলিন পরালে কাপড় পরানো বোঝা যায় না এবং ৪০ বছর পরে মসলিন বুননে বড় কাজ করা যাবে না; গবেষকদের এমন উপস্থাপনাকে অতি মিথ বলে উল্লেখ করেন সেমিনারের বিশেষ অতিথি পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম।
মসলিন ধোয়া যাবে না, বা একবারের বেশি পরা যাবে না; এটা ঠিক হলে মসলিন কতটা ব্যবহার উপযোগী তা নিয়ে ভাবতে হবে। মানুষ যদি ব্যবহার না করতে পারে তাহলে কেন কিনবে?- এমন প্রশ্ন রাখেন প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ইতিহাস-ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্য মসলিন পুনরুদ্ধার করা হয়েছে, এটা ঠিক আছে। তবে ব্যবহারে উপযোগিতা, স্থায়িত্ব, টেকসই ও খরচের বিষয়টিকে বিবেচনায় আনতে হবে। এজন্য আরও গবেষণা করতে হবে।
অতি মানবিকতা দিয়ে ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেও তা ধরে রাখা উল্লেখ করে তিনি বলেন, গবেষকদের তৈরি করা ঢাকাই মসলিনের স্যাম্পল অনেকটাই জামদানির একটি ভিন্ন সংস্ককরণ।
বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন বলেন, ঢাকাই মসলিন বাজারজাত করা গেলে মানুষ বিশ্বমানের পণ্য হিসেবে আগ্রহের সঙ্গে কিনবে। বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে বিদেশিরাও মসলিন কিনতে এগিয়ে আসবে। ঢাকার বাজারে কিছু কিছু ব্রান্ডের পোশাক হাজার হাজার টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে, ২০ হাজার টাকা কেজি দামে জিলাপি বিক্রি হচ্ছে। বাজারে আসলে মসলিনও বিক্রি হবে। এমন গ্রাহক দেশে তৈরি হয়েছে।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা গেলে ঢাকাই মসলিনের দাম কমিয়ে আনা যাবে এবং টেকসই করা যাবে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বিশ্ব জুড়ে সুনাম তৈরি হয়েছে। হাজার বছরের হৃত গৌরব মসলিন বাজারজাত করা গেলে বিশ্ববাজারে স্থান করে নেওয়া সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে আমাদের সুবিধা হল, তৈরি পোশাক শিল্পের বিদেশি ক্রেতা রয়েছে তাদের কাছে আমরা এগুলো উপস্থাপন করতে পারব। এর ফলে সহজেই মসলিনকে রপ্তানি পণ্যে পরিণত করা যাবে।
সভাপতির বক্তব্যে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুর রউফ বলেন, মসলিন প্রকল্প শেষ হওয়ার পর শুরু হবে বাজারজাত করণের প্রকল্প। এর মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
মসলিন পুনরুদ্ধর প্রকাল্পের পরিচালক আইউব আলী জানান, উন্নত মানের সুতা ও বুনন কৌশল খুবই ব্যয় বহুল। শাড়ি বুননের পর বাজারে ডিজাইন ছাড়া মসলিন বিক্রি করা যাবে ৬ লাখ ১৫ হাজার ৮৪০ টাকায়, মধ্যম মানের ডিজাইনের শাড়ি ৮ লাখ ৪৫ হাজার ১৪০ টাকা এবং ভারী ডিজাইনের দাম পড়বে ১১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।
সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল হক, টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আবুল কাশেম প্রমুখ।
বাংলাদেশ সময়:১৮৫৮ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০২৩
জেডএ/এমএমজেড