ঢাকা: মাছ-মাংস, শাক-সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি পণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে এমনিতেই নাকাল সাধারণ ক্রেতারা। নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের তো ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ অবস্থা।
বাঙালির নিত্য প্রয়োজনীয় এই দুটি পণ্যের লাগামহীন দামের কারণে, নতুন করে বিপাকে পড়তে হচ্ছে ক্রেতাদের।
বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, রাজধানীর খুচরা ও পাইকারি বাজারগুলোতে দেড় মাসের ব্যবধানে আলুর দাম বেড়েছে দেড় গুণের বেশি এবং পেঁয়াজের দাম বেড়েছে আড়াই গুণের বেশি। নিত্য প্রয়োজনীয় এই দুটি পণ্যের দাম হঠাৎ এতো বৃদ্ধির কারণ হিসেবে আমদানি বন্ধ, উৎপাদন কম, সরবরাহের ঘাটতি, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধিকেই দুষছেন বিক্রেতারা। যদিও বাজার ঘুরে সরবরাহের কোনো ঘাটতি দেখা যায়নি।
বৃহস্পতিবার (১৮ মে) রাজধানীর কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে পাইকারি বাজারে প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) আলু বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকায়। খুচরা বাজারে যা বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা কেজি দরে। অথচ দেড় মাস আগে পাইকারি বাজারে প্রতি পাল্লা আলু বিক্রি হয় ১০০ টাকায় এবং খুচরা বাজারে প্রতি কেজি বিক্রি হয় ২২-২৫ টাকায়।
হঠাৎ আলুর এমন দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের পাইকারি বিক্রেতা মো. জাহাঙ্গীর বলেন, এ বছর অনাবৃষ্টির কারণে আলুর ফলন কম হয়েছে। যে কারণে বাজারে সরবরাহ কম। তাই দাম বাড়ছে।
তবে মো. সোহেল নামের আরেক বিক্রেতা বলেন, এবার আলুর ফলন ভালো হয়েছে। বাজারেও পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে। তারপরও হিমাগার মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে আলুর বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। সকালে এক দাম থাকে, তো বিকেলে আরেক দাম।
একই কথা বললেন কারওয়ান বাজারের বিক্রমপুর ভান্ডার নামের আলুর আড়তের কর্মচারী সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, হিমাগার মালিকরা সিন্ডিকেট করে বাজারে চাহিদার তুলনায় কম আলু ছাড়ছে। যে কারণে বাজারে আলুর ঘাটতি রয়েছে, দামও বাড়ছে।
আলুর দাম আরও বাড়তে পারে- এমন ইঙ্গিত দিয়ে তিনি আরও বলেন, আমরা হিমাগারগুলো থেকে আলু কিনে এনে নিজেদের কমিশন রেখে পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করি। এখন হিমাগর থেকেই যদি আমাদের বাড়তি দামে কিনে আনতে হয়, আমরা তো বাড়তি দামেই বিক্রি করবো। কম দামে কিনে আনলে, কম দামে বিক্রি করবো। দাম বাড়ানো বা কমানোর সুযোগ আমাদের নেই।
এদিকে মাস দেড়েক আগে পাইকারি বাজারে ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া দেশি পেঁয়াজ এখন মানভেদে ৭২ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে ফরিদপুরের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭২ টাকা, রাজশাহীর পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭৬ টাকা এবং পাবনার পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা। পাল্লা প্রতি (৫ কেজি) বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ থেকে ৩৯০ টাকায়। খুচরা বাজারেও প্রায় একই দামে বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের পেঁয়াজ।
পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির জন্য কম আবাদ, ভারত থেকে আমদানি বন্ধ ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধিকেই দায়ী করছেন বিক্রেতারা।
মো. মজনু মিয়া নামের এক পাইকারি বিক্রেতা বলেন, এই মৌসুমে পেঁয়াজের উৎপাদন কম হয়েছে। তার ওপর আমদানি বন্ধ। তাই বাজারে পেঁয়াজের ঘাটতি রয়েছে। এর জন্য দাম বেশি।
তিনি আরও বলেন, ঈদের আগে যে পেঁয়াজের ৪০ কেজির বস্তা কিনেছি এক হাজার ৫০০ টাকায়, এখন সেই পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে দুই হাজার ৮০০ টাকায়। কৃষক থেকে সরাসরি কিনে বাজার পর্যন্ত আনতেই প্রতি কেজি পেঁয়াজে খরচ পড়ছে ৭৬ টাকা। তো সেই পেঁয়াজ ৭৮ থেকে ৮০ টাকা বিক্রি না করে উপায় আছে?
মো. শাহবাজ আলী নামের আরেক বিক্রেতা বলেন, ফলন কম হওয়ার কারণে বাজারে পেঁয়াজের চাহিদা মিটছে না। বর্ডার খুলে দিলে সরবরাহের ঘাটতি মিটতে পারে। তখন হয়তো দাম কমবে।
নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বাজার করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে ক্রেতাদের। তার ওপর আলুর অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধিতে তাদের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম। তাই বিক্রেতারা দাম বৃদ্ধির কারণ যাই দেখাক না কেন, ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে শুধু সাধারণ ক্রেতাদেরই।
কারওয়ান বাজার থেকে পাইকারি দরে তিন বস্তা আলু কিনেছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওসমানী হলের ক্যান্টিন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা মো. চাঁন মিয়া। বিক্রেতার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ দরাদরি করে তিন বস্তা আলুতে মাত্র ১০০ টাকা কমাতে পেরেছেন তিনি।
আলুর দাম বৃদ্ধিতে ক্যান্টিন পরিচালনায় কেমন প্রভাব পড়ছে, জানতে চাইলে মো. চাঁন মিয়া বলেন, যেই আলু আগে ১৮ টাকায় কিনতাম সেই আলু এখন ৩৪ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ২৬ টাকার পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে ৮০ টাকায়। জিনিস পত্রের দাম বাড়ছে, কিন্তু খাবারের দাম তো বাড়াতে পারছি না। কারণ দাম বাড়ালেই ছাত্ররা আন্দোলন করবে। এভাবে ব্যবসা করে লাভ তো হচ্ছেই না, বরং টিকে থাকতেই কষ্ট হচ্ছে।
পেঁয়াজের বাজারে কথা হয় সাইফুল সুমন নামের এক বেসরকারি চাকরিজীবীর সঙ্গে। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে নতুন পেঁয়াজ উঠেছে। এখন বাজারে সরবরাহের কোনো ঘাটতি থাকার কথা না। তারপরও পেঁয়াজের কেজি ৮০ টাকা। এটা ৪০ টাকা পর্যন্ত হলে হয়তো মেনে নেওয়া যেতো। কিন্তু দাম সাধ্যের প্রায় দ্বিগুণ।
নিত্যপণ্যের দামের কারণে চাহিদার তুলনায় কম বাজার ও ভোগ করতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আগে যেখানে ৫ কেজি পেঁয়াজ দিয়ে এক মাস চলতাম। এখন সেখানে দেড় মাস চলি। যেই রান্নায় আগে তিনটি পেঁয়াজ লাগতো, এখন সেখানে দুটি দিয়ে রান্না করতে হচ্ছে।
ভোক্তা অধিদপ্তরের মতো তদারকি সংস্থাগুলোর প্রতিনিয়ত বাজার পর্যবেক্ষণ ও তদারকির অভাবেই বাজারের এই অস্থিরতা বলে মনে করেন তিনি।
কারওয়ান বাজারে বাজার করতে আসা ফেরদৌসি লিজা নামের এক গৃহিনী বলেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়ে আর আমরা ভুক্তভোগী হই। আমাদের কিছু করার নেই। দাম বাড়লেও খেতে তো হবে।
এদিকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) আজকের (১৮ মে) তথ্য মতে, বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। যা এক মাস আগে ২৮ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হয়ছে। এক বছর আগে বিক্রি হয়েছে ১৮ থেকে ২৫ টাকায়। তাদের মতে, গত এক মাসে এই পণ্যটির দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ২৯ দশমিক ৩১ শতাংশ এবং এক বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৪ দশমিক ৪২ শতাংশ।
এছাড়া বর্তমানে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায়। যা এক সপ্তাহ আগে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়, এক মাস আগে ৩০ থেকে ৪০ টাকায় এবং এক বছর আগে ৩৮ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তাদের মতে, গত এক মাসে এই পণ্যটির দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ১২১ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং এক বছরে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৮৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৫ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০২৩
এসসি/এনএস