রাজশাহী: শেষ পর্যন্ত জমতে শুরু করেছে আমের রাজধানী রাজশাহী। মধ্য জ্যৈষ্ঠ মাসে পরিপক্ব হয়ে উঠছে রাজশাহীর বেশিরভাগ বাগানের আম।
স্বাদ ও গুণ অটুট থাকলেও এবার আমের আকার হয়েছে ছোট। আর সরবরাহ বাড়লেও কমেনি দাম। সাধারণত ৮শ থেকে এক হাজার ২শ টাকা মণ দিয়ে জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম সপ্তাহে বাজারে মুখে মৌসুমের প্রথম যাত্রা শুরু করে জাত আম খ্যাত গোপালভোগ। এরপর জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ সপ্তাহে তা গিয়ে চার হাজার ৫শ টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা মণ পর্যন্ত দাম গিয়ে ঠেকে।
গেল বছরের চিত্রও এমনটাই ছিল। কিন্তু এবার গোপালভোগ আম দেরি করে নামানো হচ্ছে। আর দাম শুরুতেই ছিল দুই হাজার ৪শ টাকা মণ। আর আকার ভেদে মধ্য জ্যৈষ্ঠ মাসেই সেই গোপালভোগ আমের দাম উঠেছে দুই হাজার ৮শ টাকা থেকে তিন হাজার টাকা!
ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রি হচ্ছে আরও বেশি দামে। তাই আমের বাড়তি দাম নিয়ে অস্বস্তিতে আছেন সাধারণ ক্রেতা ও ভোক্তারা। মুনাফায় আছেন মধ্যস্বত্বভোগী, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।
প্রকৃত আম চাষি এই বাড়তি মুনাফা থেকে বরাবরের মতোই হচ্ছেন বঞ্চিত। উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় কয়েকজন চাষিই সরাসরি হাট-বাজারে গিয়ে আম বিক্রি করেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল, পরিবহন খরচ ও দূরত্বের কারণে বেশিরভাগ আম চাষিই খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বাগান থেকে কম দামে আম বিক্রি করে দেন। সেই আম তারা আবার বড় মহাজনের কাছে বিক্রি করেন। তারা আবার আড়তদারদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করেন। পাইকারি আড়ত থেকে ওই আম নিয়ে গিয়ে আরও বেশি লাভে খুচরা বাজারে বিক্রি করা হয়। ফলে বাগানে বিক্রি আম ভোক্তাদের কাছে চার হাত ঘুরে ঘুরে পৌঁছায়। আর এতে দেড় থেকে দুইগুণ পর্যন্ত দাম বেড়ে যায়। মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হন চাষি ও ভোক্তারা।
রাজশাহীতে সবচেয়ে বড় আমের মোকাম পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর।
ওই হাটে গিয়ে দেখা যায়, আজ আকারভেদে গোপালভোগ আম দুই হাজার ৪শ (ছোট), দুই হাজার ৬শ (মাঝারি) এবং দুই হাজার ৮শ (বড়) টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে গেল বার যে আম মাঝারি ছিল তাই এবার বড় হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। আর ছোট আম আরও ছোট। চিনতে না পারলে অনেক ক্ষেত্রেই অপরিপক্ব আম কিনে নিয়ে যাওয়ার পর তা পাকার আগেই কালো হয়ে পচে যাচ্ছে।
আর সদ্য বাজারে আসা হিমসাগর আম বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৪শ থেকে দুই হাজার ৬শ টাকা মণ দরে। ওই হাটে কম মিষ্টির লক্ষ্মণভোগ বা লকনা আম এক হাজার ৫শ টাকা থেকে ১ হাজার ৮শ টাকা ও রানিপছন্দ আম দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২শ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে আজ। এছাড়া মৌসুমের প্রথম নামা গুটি এবং গত সপ্তাহ থেকে বাজারে আসা তোতাপুরিসহ বিভিন্ন বনেদি জাতের আমের দাম এক হাজার ৫শ থেকে এক হাজার ৮শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতে দেখা গেছে পুঠিয়ার বানেশ্বর হাটে।
পুঠিয়ার বানেশ্বর হাটের আম ব্যবসায়ী শামীম মিয়া বলেন, আমের দাম প্রতিদিনই বাড়ে। সাধারণত জাতভেদে আম ওঠার পর সেই আম শেষ হওয়া হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ১শ থেকে মণ প্রতি ২শ টাকা করে বাড়ে। আর মৌসুমের শেষ হয়ে এলে আমের সরবরাহ কমতে থাকে। তখন দুই দিন পর পর এক লাফে মণ প্রতি আমের দাম ৫শ টাকা পর্যন্ত বাড়ে। তাই আমের দাম এখন আর কমবে না। বাড়তেই থাকবে।
এদিকে তীব্র খরার কারণে চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে আমের আকার তুলনামূলকভাবে ছোট হয়েছে বলে জানান শফিকুল আলম নামের আরেক আম ব্যবসায়ী।
প্রতিকূল আবহাওয়ার পরও রাজশাহীতে এবার আমের বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রায় প্রতিটি বাগানের গাছেই প্রচুর আম ধরায় উৎপাদন নিয়ে আশাবাদী বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
সামনে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে না পড়লে এবার আম বেচা-কেনা করে লাভবান হবেন বলে আশাবাদী তারা।
এছাড়া আম নামানো প্রশ্নে আফাজ উদ্দিন মোল্লা নামের একজন আম চাষি ও ব্যবসায়ী বলেন, এবার জেলা প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সময়েরও অনেক পরে বাগান থেকে সবাই আম নামাচ্ছেন। এবার মৌসুমের শুরুতে প্রচুর পরিমাণ মুকুল আসায় বাগানগুলো এখনও কাঁচা-পাকা আমে ঠাসা। তাই রাজশাহী জেলার অধিকাংশ বাগানে ঝুলছে গোপালভোগ, ল্যাংড়া, ফজলি, ক্ষীরসাপাত, রানিপছন্দ ও লক্ষ্মণভোগসহ হরেক জাতের সুস্বাদু সব আম। আর সপ্তাহ দুয়েক পরই পরিপক্ব হয়ে উঠবে সব আম। এরপর পর্যায়ক্রমে আম বাজারে উঠতে শুরু করবে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ডিডি) মোজদার হোসেন বলেন, এবার রাজশাহীতে এক হাজার ৫শ কোটি টাকার আম বাণিজ্য হবে বলে আশা করা হচ্ছে। রাজশাহীতে এবার ১৯ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমিতে প্রায় ৩৩ লাখ ৬৩ হাজার ৯৮৬টি আমগাছ আছে। এবার জেলায় ৯৫ শতাংশ গাছে মুকুল এসেছিল। গেল বার ১৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে আমবাগান ছিল। এবার বাগান বেড়েছে এক হাজার ৬৩ হেক্টর জমিতে।
এবার হেক্টর প্রতি ১৩ দশমিক ২০ টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে জেলায় এ বছর মোট দুই লাখ ৫৮ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হবে বলেও জানান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৫ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০২৩
এসএস/এএটি