ঢাকা: করোনা মহামারি ও ডলারের উচ্চমূল্যের ধকল কাটিয়ে না উঠতেই হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি ও অস্থিতিশীলতায় দেশের বৃহৎ বাইসাইকেল মার্কেটে হাহাকার লেগেছে।
আগামী কয়েক মাস এই দশা অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা করছেন রাজধানীর বংশালের সাইকেল ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, করোনাকালের পর বংশালের সাইকেল ব্যবসায়ীরা উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ পাননি। এরপর অবরোধে জমজমাট এই মার্কেট ক্রেতাশূন্য হয়ে গেছে। গত দুই সপ্তাহে বেচাবিক্রি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, যা নির্বাচনের আগে আর ভালো হওয়ার সুযোগ নেই।
সাইকেলবিক্রেতা ও আমদানিকারকরা বলছেন, দেশের বৃহৎ এই সাইকেলের মার্কেটে যেন হাহাকার লেগেছে। হরতাল- অবরোধের জন্য দুই সপ্তাহ ধরে ক্রেতাশূন্য। করোনার মধ্যেও এরকম অবস্থা হয়নি।
তারা আরও বলেন, করোনা মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে বাইসাইকেল আমদানি কমেছে কয়েকগুণ। ডলারের দাম বাড়ায় সাইকেলের দামও বেড়েছে। বর্তমানে আমাদের শুধু ভারত ও চীন থেকে সাইকেল আসে। চীনের সাপ্লাই চেইন ভালো আছে। কিন্তু ভারত একটু স্লো রয়েছে। যেসব সাইকেল বাজারে আছে, অবরোধের জন্য সেগুলোও বিক্রি হচ্ছে না। নতুন করে আমদানি করে কী হবে?
পুরান ঢাকার বংশালের কাজী আলাউদ্দিন রোডের দুই পাশে ১৫০ থেকে প্রায় ২০০ শোরুম। শোরুমগুলোতে সারি সারি সাজানো বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দেশি বিদেশি সাইকেল। তবে বাজারে ভারত ও চীনা কোম্পানিগুলোর প্রভাব বেশি। হিরো রেঞ্জার, হিরো, মেরিডা, ফরমেট, ভেলোস, ফিনিক্স, বেবি স্পেসের সাইকেলের ছড়াছড়ি।
এছাড়া দেশীয় কোম্পানির ভেলোস, রিফ্লেক্স, দুরন্ত ব্র্যান্ডের সাইকেলের কদরও আছে। ইলেকট্রিক বা ব্যাটারিচালিত সাইকেলের দেখা মিলল। পাশাপাশি সাইকেলের বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে জায়ান্ট, জিটি, সান্তাক্রুজ, ট্রেক, স্পেশালাইজড, মেরিডা, ক্যাননভেল, স্কট, মারিন ইত্যাদি সাইকেলও পাওয়া যায় বংশালের সাইকেল মার্কেটে।
রোববার (১২ নভেম্বর) সকাল থেকে বিএনপি-জামায়াতের চতুর্থ দফার অবরোধ চলছে। এ দিন দুপুরে বংশালে গিয়ে দেখা যায়, সাইকেলের শোরুমগুলো খুলে বসে আছেন বিক্রেতারা। তবে কোনো ক্রেতা নেই। প্রতিটি শোরুমের সেলসম্যান বেকার সময় পার করছেন। পাশের শোরুমের লোকের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটাচ্ছেন। জমজমাট এই মার্কেট ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে। দুই-একটি শোরুমে এক-দুজন ক্রেতা দেখা গেলেও বেশির ভাগ শোরুম ছিল ফাঁকা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সাইকেল অ্যাসোসিয়েশন ও ইমপর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিবুর ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, করোনার পর নানা কারণে বংশালের সাইকেল ব্যবসায়ীরা উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ পাননি। করোনার পর ডলারের উচ্চমূল্য এখন আবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, যা আগামী কয়েক মাস চলবে। এ সময়ে আমরা সাইকেল আমদানি করে কী করব?
তিনি আরও বলেন, হরতাল-অবরোধসহ নির্বাচনের সময়ে নানান জটিলতায় বেচাবিক্রি কমে যাবে। আসলে বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো ব্যবসাই ভালো নেই। নির্বাচনের আগে আর ব্যবসা ভালো হওয়ার সুযোগ নেই। গ্রামের শোরুমগুলোতে চাহিদা থাকলেও শহরে চাহিদা কমেছে। অবরোধের জন্য গত দুই সপ্তাহ ধরে ব্যবসা একেবারে কমে গেছে। ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে বংশালের সাইকেল মার্কেট।
হাবিবুর ইসলাম আরও বলেন, ডলারের দামের কারণে আমদানি কমে যাওয়ার পাশাপাশি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। ফলে আমরা আর লাভ করতে পারি না। এর পাশাপাশি সরকার দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহ দিতে সাইকেলের পার্টস আমদানিতে ডিউটি বাড়িয়েছে। তবে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ভালো সাইকেল তৈরি করছে। রপ্তানিও হচ্ছে। ফলে দেশি কোম্পানিগুলো সুবিধা বেশি পাচ্ছে।
হিরো সাইকেলের প্রোপাইটার নজিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, অবরোধের কারণে আগের চেয়ে সাইকেলের বিক্রি কমেছে। আগে দিনে গড়ে ৬ থেকে ৮টি সাইকেল বিক্রি করলেও গত দুই সপ্তাহ ধরে বিক্রি তলানিতে ঠেকেছে। এখন দিনে একটি বা দুটি সাইকেল বিক্রি করতে পারি। ক্রেতা নেই বললেই চলে। অবরোধে কেউ এখন আর মার্কেটমুখী হচ্ছে না। এখন যারা বাইসাইকেল কিনতে আসে তারা শুধু বাচ্চাদের সাইকেল বেশি কিনছে। বর্তমানে বাচ্চাদের সাইকেল ব্র্যান্ডভেদে সাড়ে ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৮ হাজার টাকায় পাওয়া যায়। আর বড়দের সাইকেলের দাম পড়ে ৮ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। এগুলো সবই আমদানি করা সাইকেলের দাম।
তিনি বলেন, বাজারে এখন ভারত ও চায়নিজ ব্র্যান্ডের সাইকেল বেশি বিক্রি হয়। দেশীয় ব্র্যান্ডের মধ্যে ভেলোস সাইকেল বিক্রিতে এগিয়ে। ঢাকায় সচরাচর ফ্যাশনেবল সাইকেলগুলোই বেশি চলে। দেশে এখন মেঘনা, রানার, আরএফলসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিশ্বমানের সাইকেল তৈরি করছে। মানুষ এখন দেশিব্র্যান্ডের সাইকেল পছন্দ করছে।
মুজিব’স ট্রেডাসের সেলসম্যান রিপন বাংলানিউজকে বলেন, করোনার ধকল কাটিয়ে না উঠেতেই আবার অবরোধ আমাদের ব্যবসার ১২টা বাজিয়ে দিয়েছে। ব্যবসা নাই বলেই চলে। আগে একদিনে যে বেচাকেনা হতো, এখন ৬ দিনে সেই বেচা কেনা হয় না। বাচ্চাদের সাইকেল সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা থেকে শুরু সর্বোচ্চ ৯ হাজার টাকা। বড়দের ৮ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা; এই দামেই সাইকেল বেশি চলে। এখন দিনে এক থেকে দুইটা বিক্রি করি। আগে যেখানে ৫ থেকে ৭টা বিক্রি হতো। অবোরেধের কারণে কাস্টমার নেই। যাও আসে দেখে চলে যায়।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মো. আব্দুল। তিনি এসেছেন ছেলের জন্য সাইকেল নিতে। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, হরতাল অবরোধে গাড়িতে আগুন দেয়। ছেলেটা সিটি কলেছে পড়ে, বাসে গেলে ভয় লাগে। তাই একটা সাইকেল কিনতে এসেছি। যাতে নিরাপদে যেতে পারে। আর ছেলেটাও অনেকদিন আগে থেকেই সাইকেলের জন্য বায়না ধরেছে। আজকে এসেছি কিনতে। কিন্তু পছন্দের সাইকেল নিতে পারছি না দামের জন্য। অনেক দাম বেড়েছে।
বাংলাদেশ সাইকেল অ্যাসোসিয়েশন ও ইমপর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুসারে, প্রতি বছর স্থানীয় বাজারে সাইকেলের চাহিদা থাকে ১ দশমিক ৫ মিলিয়নের কাছাকাছি। যার বাজার মূল্য চার হাজার কোটি টাকা। দিন দিন এ বাজার বাড়ছে। ২০১০ সাল থেকে প্রতিবছর ১০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করে সাইকেল বিক্রি বাড়ছে।
পুরান ঢাকার বংশালে প্রায় ২০০টির মতো সাইকেলের দোকান রয়েছে। যদিও বাংলাদেশে আমদানি-নির্ভর সাইকেলের চাহিদাই বেশি। তবে স্থানীয় উৎপাদকরা রপ্তানির মাধ্যমেও একটি ভালো মুনাফা অর্জন করছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০২৩
জিসিজি/এমজেএফ/এসএএইচ