ঢাকা: দেশের তৈরি পোশাকের একটি বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লে অর্ডার দেওয়া পণ্য না নেওয়া বা লেনদেন না করার শর্ত দিয়েছে। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)।
সংগঠনের সভাপতি ফারুক হাসান বৃহস্পতিবার (৭ ডিসেম্বর) এক বিবৃতি বলেন, বিশ্ব বাণিজ্যের দৃশ্যপট দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে; মানবাধিকার এবং পরিবেশগত ডিউ ডিলিজেন্স ক্রমবর্ধমানভাবে অগ্রাধিকার পাচ্ছে, অন্যদিকে ভূ-রাজনৈতিক বিষয়গুলোও বাণিজ্যকে প্রভাবিত করছে। যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাণিজ্যের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল, তাই বাণিজ্যনীতি সংক্রান্ত যে কোনো নতুন বিষয় আমাদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। তাই, বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করার জন্য আমি এই বিবৃতি দেওয়ার তাগিদ অনুভব করছি।
তিনি বলেন, সম্প্রতি বিজিএমইএ এর এক সদস্যকে বিদেশি ক্রেতার পাঠানো একটি লেটার অব ক্রেডিটের (এলসি) অনুলিপি আমাদের নজরে এসেছে। এলসিতে রয়েছে- ‘আমরা জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, যুক্তরাজ্য কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত কোনো দেশ, অঞ্চল বা দলের সঙ্গে লেনদেন প্রক্রিয়া করবো না। নিষেধাজ্ঞার কারণগুলোর জন্য আমরা কোনো বিলম্ব, নন-পারফরমেন্স বা/ তথ্য প্রকাশের জন্য দায়ী নই। ’
ফারুক হাসান বলেন, এই ধারাটির ব্যাখ্যায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে বলে উদ্বেগ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, যা সঠিক নয়। এটি উল্লেখ্য যে এলসিটি একটি নির্দিষ্ট ক্রেতার কাছ থেকে এসেছে এবং এটি কোনো দেশের দ্বারা সংবিধিবদ্ধ আদেশ বা বিজ্ঞপ্তি নয়। সুতরাং এটিকে বাংলাদেশের ওপর বাণিজ্য ব্যবস্থা প্রয়োগ বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের বার্তা হিসাবে ভুল ব্যাখ্যা করা উচিত হবে না।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, এটিকে আরও স্পষ্ট করে বলছি যে স্বতন্ত্র ক্রেতা/প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ নীতি এবং প্রোটোকল থাকতে পারে, তবে একটি এলসি কপি বা একটি ব্যক্তিগত বাণিজ্যিক ইনস্ট্রুমেন্ট কোনো অফিসিয়াল ঘোষণা নয়। তাছাড়া, বিজিএমইএ আমাদের কূটনৈতিক মিশন থেকে বা কোনো অফিসিয়াল সোর্স থেকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা বা বাণিজ্য ব্যবস্থা আরোপের কোনো তথ্য পায়নি।
তিনি বলেন, শ্রমিকদের অধিকার এবং কল্যাণকে আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছি। বাংলাদেশ সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে একটি শ্রম রোডম্যাপ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং ২০১৩, ২০১৮ এবং ২০২৩ সালে শ্রম আইনের সংশোধনসহ এটি বাস্তবায়নের জন্য সমস্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শ্রম বিধিগুলো ২০১৫ সালে জারি করা হয়েছিল এবং ২০২২ সালে সংশোধন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন ২০১৯ সালে পাস করা হয় এবং ২০২২ সালে ইপিজেড শ্রম বিধি জারি করা হয়।
একটি কারখানার ইউনিয়ন নিবন্ধনের জন্য ৩০ শতাংশ শ্রমিকের অংশগ্রহণের পূর্ববর্তী শর্ত (থ্রেশহোল্ড) শিথিল করে ২০ শতাংশ করা হয়েছিল, যা কিনা বাংলাদেশের শ্রম আইনের (বিএলএ) সাম্প্রতিক সংশোধনীতে আরও হ্রাস করে ৩০০০ এরও বেশি শ্রমিক নিয়োগকারী কারখানাগুলোর জন্য ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। গ্রুপ অব কোম্পানিজের জন্য থ্রেশহোল্ড ৩০ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য কেন্দ্রীয় তহবিলে অবদান রাখা আইনত বিধান করা হয়েছে; ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই তহবিলে শিল্প প্রায় ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অবদান রয়েছে। জিআইজেড এবং আইএলওর সহযোগিতায় এমপ্লয়মেন্ট ইনজুরি স্কিম (ইআইএস) এখন পোশাক শিল্পে পাইলটিং করা হচ্ছে। নির্বাচিত শ্রমিকদের অংশগ্রহণ কমিটি এবং নিরাপত্তা কমিটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বিশ্বের সেরা পারফর্মিং বেটার ওয়ার্ক কারখানাগুলোর মধ্যে কয়েকটি বাংলাদেশে রয়েছে উল্লেখ করে বিজিএমইএ সভাপতি শ্রমিকদের অধিকার সমুন্নত রাখা এবং শ্রমিকদের কল্যাণ বাড়াতে কিছু উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন বিবৃতিতে।
ফারুক হাসান বলেন, ২০১৩ সালে মর্মান্তিক ভবন ধসের দুর্ঘটনার পর, শিল্পটি জাতীয় উদ্যোগের নেতৃত্বে একটি বড় নিরাপত্তা সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে এবং ক্রেতাদের চালিত প্রোগ্রাম, অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ, অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি দ্বারা উল্লেখযোগ্যভাবে সংস্কার হয়েছে।
শ্রমিকদের আর্থিক সুবিধার ক্ষেত্রে ২০১০ সাল থেকে ন্যূনতম মজুরি ছয়গুণেরও বেশি বেড়েছে জানিয়ে তিনি আরও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ করেন।
এক্ষেত্রে সবুজ রূপান্তরের ক্ষেত্রেও এগিয়ে থাকার কথা উল্লেখ করে ফারুক হাসান বলেন, বাংলাদেশ এখন ২০৪টি লিড প্রত্যয়িত পরিবেশবান্ধব কারখানার আবাসস্থল, যার মধ্যে ৭৪টি প্ল্যাটিনাম রেটেড এবং ১১৬টি গোল্ড রেটেড।
তিনি বলেন, আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের অনেক রপ্তানি বাজারের জন্য মানবাধিকার এবং পরিবেশগত ডিউ ডিলিজেন্স ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার আমাদের বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। গত ১৬ নভেম্বর ইউএস প্রেসিডেন্সিয়াল মেমোরান্ডাম কর্মীর ক্ষমতায়ন, অধিকার এবং বিশ্বব্যাপী চলমান লেবার ক্যাম্পেইনের সঙ্গে উচ্চ শ্রমমান জুড়ে দিয়ে স্বাক্ষর করেছে, যা এনগেজমেন্ট এবং প্রয়োগের দিক থেকে বেশ স্বতন্ত্র বলে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে। আমরা এর তাৎপর্যকে সম্মান করি এবং এর মূল নীতিগুলোর সঙ্গে একাত্মতা খুঁজে পাই। যদিও স্মারকলিপিতে ‘কূটনৈতিক ও সহায়তার সম্পূর্ণ ব্যবস্থা এবং যথাযথ আর্থিক নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্য জরিমানা, ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং অন্যান্য পদক্ষেপ’সহ বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, তবে এটি বাংলাদেশের জন্য গৃহীত নয়, বরং এটি শ্রমিক অধিকার ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা অবস্থান।
ফারুক হাসান বলেন, আমরা অতীতেও একই ধরনের উদাহরণ দেখেছি; এক ক্রেতার কাছ থেকে আসা একটি এলসি ক্লজ উদ্ধৃত করে এটিকে বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা হিসেবে সাধারণীকরণ করা হয়েছে এবং আমরা এ ধরনের ভুল তথ্য উপস্থাপনের বিরুদ্ধে সব সময়ই আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছি। তবে, আমরা বাণিজ্যিক কাগজপত্র ও উপকরণে এই ধরনের ধারা অন্তর্ভুক্ত করাকে সমর্থন করি না, যদি এটি শুধুমাত্র বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনুশীলন করা হয়। বিজিএমইএ তার সদস্যদের, যারা উপরে উল্লিখিত এই জাতীয় ধারাসহ এলসি গ্রহণ করে, তাদের সংশ্লিষ্ট ব্র্যান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে এর একটি স্পষ্টীকরণ চাওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। যদি ধারাটি কেবল বাংলাদেশি সরবরাহকারীদের অনুকূলে জারি করা এলসিগুলোতে থাকে, তবে এটি নৈতিকতা লঙ্ঘন করে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে, আমরা আমাদের সদস্য কারখানাগুলোকে বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার জন্য এবং প্রয়োজনে এই ধরনের ক্রেতাদের সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি পর্যালোচনা/পুনর্বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করবো।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০২৩
এইচএ/