ঢাবি: বাংলাদেশের ইলেক্ট্রিক ও লাইটিং পণ্যের বাজারে দেশীয় কোম্পানিগুলো আধিপত্য বিস্তার করছে। গত দুই দশক থেকে এই পণ্যের বাজার অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশের (এমডব্লিউবি)’ এক গবেষণায় এমন তথ্য মিলেছে।
শনিবার (১৮ মে) দুপুর সাড়ে ১২টায় মার্কেটিং বিভাগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. এ বি এম শহিদুল ইসলাম, এমডব্লিউবি-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান এবং অধ্যাপক ড. মো. নাজমুল হোসাইন।
গবেষণার আওতায় আনা পণ্যগুলো ছিল- সুইচ, সকেট, হোল্ডার, মাল্টি-প্লাগ, সার্কিট ব্রেকার, মিটার এবং বিভিন্ন হালকা পণ্য যেমন: এলইডি লাক্স, এলইডি টিউব, এলইডি প্যানেল, ব্র্যাকেট এলইডি, জিএলএস, এনার্জি এফিশিয়েন্সি বাল্ব, ইমার্জেন্সি লাইটিং অপশনস। পরিসর বড় হওয়ায় ইলেকট্রিক ক্যাবল এই গবেষণার আওতায় আনা হয়নি।
গবেষণায় দেশের ৮ টি বিভাগের গ্রাম ও শহর থেকে ২০১৬ জন ভোক্তা, ১০৩ জন খুচরাবিক্রেতা, ৯৯ জন ইলেকট্রিক মিস্ত্রী এবং এই শিল্পের পাঁচজন বিশেষজ্ঞের মতামত বিশ্লেষণ করা হয়।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার খুচরাবিক্রেতা এবং ২ হাজার ৫০০ উদ্যোক্তাসহ মোট ৫ লাখেরও বেশি মানুষ ইলেকট্রিক শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। দুই ক্যাটাগরির পণ্যের সম্মিলিত বাজারের আকার ৫ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যার মধ্যে ইলেক্ট্রিক্যাল জিনিসপত্রের বাজার প্রায় ৩ হাজার ৩০০ কোটি এবং লাইটিং পণ্যের বাজার প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ইলেক্ট্রিক্যাল জিনিসপত্র ও লাইটিং পণ্যের গড় প্রবৃদ্ধির হার যথাক্রমে প্রায় ১০ শতাংশ এবং ১৩ শতাংশ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই বাজারে মোট শেয়ারের প্রায় অর্ধেক নিম্নমানের নকল ও অনুমোদনহীন পণ্য দখল করে আছে। দেশীয় কোম্পানিগুলোর প্রবৃদ্ধির হার বেশি হওয়ায় আগামীতে তারা বাজারে আধিপত্য বিস্তার করবে।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য মতে, ইলেকট্রিক জিনিসপত্র ও লাইটিং পণ্যের ক্ষেত্রে দেশীয় কোম্পানি সুপারস্টার বাজারে শীর্ষস্থানে আছে। ইলেক্ট্রিক্যাল জিনিসপত্রের ব্রান্ডেড পণ্যের মার্কেট শেয়ারে সুপারস্টার ২৯ শতাংশ, ওয়ালটন ১৭ শতাংশ, ক্লিক ১৭ শতাংশ, এনার্জি প্যাক ৯ শতাংশ, ওসাকা ৪ শতাংশ এবং ব্লিঙ্ক, এমইপি ও লাক্সারি প্রত্যেকে ৩ শতাংশ করে বাজার দখল করে আছে।
অন্যদিকে ব্রান্ডেড লাইটিং পণ্যের মার্কেট শেয়ারে সুপার স্টার ২৫.৫৯ শতাংশ, ক্লিক ১৩ শতাংশ, ওয়ালটন ১২ শতাংশ, ট্রান্সটেক ১০ শতাংশ, এনার্জি প্যাক ৮ শতাংশ এবং ফিলিপস ৭ শতাংশ বাজার দখল করে আছে।
গবেষণায় জড়িত অধ্যাপক মো. মিজানুর রহমান বলেন, গত ২৫ বছরে ব্যাপক বিদ্যুতায়ন, অব্যাহত জিডিপি প্রবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান আয়, দ্রুত ও পরিকল্পিত নগরায়ণ, গ্রামীণ উন্নয়ন এবং সরকারের গৃহীত সমন্বিত উদ্যোগ এই অগ্রগতির পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
দাম দেখে পণ্য কেনার প্রবণতা বেশি
গবেষণায় দেখা গেছে, ইলেকট্রিক ও লাইটিং পণ্যের ক্ষেত্রে ভোক্তারা সবচেয়ে বেশি বিবেচনা করেন পণ্যের দাম। এরপর গুরুত্ব দেন ওয়ারেন্টির ওপর। ইলেকট্রিক পণ্যের ক্ষেত্রে ২২ শতাংশ পণ্যের দাম, ২০ শতাংশ পণ্যের ওয়ারেন্টি, ১৮ শতাংশ টেকসই ক্ষমতা বিবেচনা করেন।
লাইটিং পণ্যের ক্ষেত্রে ২১ শতাংশ পণ্যের দাম, ২০ শতাংশ ওয়ারেন্টি এবং ১৯ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে গুরুত্ব দেন।
ইলেকট্রিক জিনিসপত্র কেনার ক্ষেত্রে মাত্র ১১ শতাংশ এবং লাইটিং পণ্যের ক্ষেত্রে মাত্র ৮ শতাংশ ব্র্যান্ড ইমেজ ও খ্যাতি বিবেচনা করেন।
ওয়ারেন্টি শেষ হতেই বিকল পণ্য
গবেষণার তথ্য মতে, অধিকাংশ ইলেক্ট্রনিক জিনিসপত্র নষ্ট হয় সংযোগ সমস্যা ও শর্ট সার্কিটের কারণে। এই দুই কারণে প্রায় ৪৩ শতাংশ পণ্য বিকল হয়। এছাড়া, ভোক্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯ শতাংশ পণ্য ওয়ারেন্টি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বিকল হয়ে পড়ে।
লাইটিং পণ্যের ২৭ শতাংশ সময়ের সাথে আলো কমে যায়। ২৩ শতাংশ ক্ষেত্রে সীমিত সময়ে নষ্ট হয়ে যায়।
মিস্ত্রি ও দোকানিদের পরামর্শে কেনার হার বেশি
গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ মানুষ মিস্ত্রী ও দোকানিদের কাছ থেকে ইলেকট্রিক ও লাইটিং পণ্য কেনার তথ্য সংগ্রহ করেন। এই দুই উৎস থেকে ৫১ শতাংশ ক্ষেত্রে তথ্য গ্রহণ করেন গ্রাহকরা। অন্যদিকে টেলিভিশন ও পত্রিকার বিজ্ঞাপন থেকে মাত্র ২৫ শতাংশ মানুষ পণ্যের তথ্য গ্রহণ করেন।
পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রিক দোকানি ও মিস্ত্রিরা ৮২ দশমিক ৩১ শতাংশ ক্ষেত্রে গ্রাহকদের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করেন।
ড. মো. নাজমুল হোসাইন বলেন, বাংলাদেশের বাজারের প্রায় ৫০ শতাংশ অনুমোদনহীন পণ্য দখল করে আছে। মানুষের মধ্যে ব্র্যান্ডের পণ্য কেনার প্রবণতা বাড়ছে। ফলে আগামীতে এই শিল্প অপার সম্ভাবনাময়।
গবেষণায় এই শিল্পের কয়েকটি চ্যালেঞ্জ এবং তার সমাধানে কিছু প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।
চ্যালেঞ্জগুলো হলো গ্রে মার্কেটের আধিপত্য, অসম প্রতিযোগিতা, ভোক্তাদের মধ্যে ব্র্যান্ড সম্পর্কে কম সচেতনতা, সাপ্লাই চেইন ও গুণ নিয়ন্ত্রণ, নীতি এবং নিয়ন্ত্রক ক্ষেত্র, খুচরা ও ইলেকট্রিক মিস্ত্রিদের আধিপত্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্দান্ত সম্ভাবনাময় এই শিল্পের প্রবৃদ্ধির জন্য গ্রে-মার্কেটের কার্যক্রম হ্রাসে সরকারের তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। একই সাথে দেশীয় কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করার জন্য সরকারের বিদ্যমান ট্যাক্স পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন করতে হবে, যাতে কোম্পানিগুলো কম ব্যয়ে পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করতে পারে।
পাশাপাশি এ সমস্ত শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ গড়ে তোলার জন্য সরকার এবং ব্যবসায়ীদের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি জনগণের মধ্যে নিরাপদ ও মানসম্মত বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ব্যবহারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
সার্বিক বিষয়ে বিভাগের চেয়ারম্যান এ বি এম শহিদুল ইসলাম বলেন, এই গবেষণার যাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেরকম একটি অংশ তথা পলিসি নির্মাতাদের বক্তব্য এখানে নেওয়া সম্ভব হয়নি। সরকার এই ক্ষেত্রের উপর আরও বেশি পরিসরে গবেষণা করতে পারে। তার ভিত্তিতে পলিসি তৈরি করতে পারবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৪ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০২৪
এসএএইচ