ঢাকা: দেশে প্রথমবারের মতো আয়োজিত ‘আন্তর্জাতিক জুয়েলারি মেশিনারিজ’ প্রদর্শনীতে উদ্বোধনী দিনেই দর্শনার্থীদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। তিন দিনব্যাপী এই প্রদর্শনীর দ্বিতীয় দিনেও এর ব্যতিক্রম দেখা যায়নি।
গত বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরার (আইসিসিবি) পুষ্পগুচ্ছ হলে শুরু হয় প্রথম আন্তর্জাতিক জুয়েলারি মেশিনারিজ প্রদর্শনী বাংলাদেশ (আইজেএমইবি)-২০২৪। এদিন ফিতা কেটে আন্তর্জাতিক এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম। বিশেষ অতিথি ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহ-সভাপতি আমিন হেলালী, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও নিটল নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদ।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বসুন্ধরা গ্রুপের পরিচালক আহমেদ ইব্রাহিম সোবহান, ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের পরিচালক ও কালের কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, বসুন্ধরা গ্রুপের প্রেস অ্যান্ড মিডিয়া উপদেষ্টা মোহাম্মদ আবু তৈয়ব এবং বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন-বাজুসের নেতারা।
‘গহনায় হোক প্রযুক্তির ছোঁয়া’ প্রতিপাদ্য নিয়ে যৌথভাবে আন্তর্জাতিক এই প্রদর্শনীর আয়োজন করে দেশের ঐতিহ্যবাহী ও পণ্যভিত্তিক সর্ববৃহৎ বাণিজ্য সংগঠন বাজুস ও ভারতীয় প্রতিষ্ঠান কেএনসি সার্ভিসেস।
শুক্রবার (৫ জুলাই) সকালে প্রদর্শনীর দ্বিতীয় দিনে আইসিসিবির পুষ্পগুচ্ছ হলে গিয়ে দেখা যায়, বেলা ১১টায় প্রদর্শনীর দ্বার উন্মুক্ত হতে না হতেই জুয়েলারি শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকে এসে ভিড় জমাচ্ছেন সেখানে। জুয়েলারি শিল্পের মেশিনারিজ সম্পর্কে জানতে স্টলগুলোতে ভিড় করছেন জুয়েলারি ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানিও ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে দর্শনার্থীদের তাদের তৈরি আধুনিক জুয়েলারি মেশিনারিজ দেখাচ্ছে এবং সেগুলো সম্পর্কে জানাচ্ছে।
বর্তমানে আধুনিক যুগে প্রায় প্রতিটি খাতেই প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। তবে দেশের স্বর্ণশিল্পে এখনো আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। কারিগররা সনাতনী পদ্ধতিতে তাদের নিপুণ হাতে বাহারি নকশার স্বর্ণালঙ্কার তৈরি করলেও এতে স্বর্ণের ক্ষয়ে নষ্ট হয় কিছুটা। যে কারণে বেড়ে যায় স্বর্ণালঙ্কারের দাম। তবে আধুনিক মেশিনারিজ দিয়ে স্বর্ণালঙ্কার তৈরি করলে এই ক্ষয় অনেকটাই হ্রাস পায়। বাঁচে সময়ও। তাই স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও কারিগরদের আধুনিক মেশিনারিজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে আয়োজন করা হয়েছে আন্তর্জাতিক এই প্রদর্শনীর। যেখানে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এক ছাদের নিচে তাদের তৈরি মেশিনারিজ প্রদর্শন করে সেগুলোর উপকারিতা সম্পর্কে জুয়েলারি শিল্প সংশ্লিষ্টদের জানতে পারছেন।
প্রদর্শনীর আয়োজকরা জানান, দেশে প্রথমবারের মতো আয়োজিত আন্তর্জাতিক এই প্রদর্শনীতে ভারত, ইতালি, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জার্মানি, চীন ও থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের ১০টি দেশের প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। আগামী ৬ জুলাই পর্যন্ত চলবে এই প্রদর্শনী। এই তিন দিন বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত প্রদর্শনীটি ব্যবসায়ী দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
স্বর্ণালঙ্কার তৈরির প্রায় ৪০ ধরনের মেশিনারিজ নিয়ে এই প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছে পুরান ঢাকার তাঁতী বাজারের প্রতিষ্ঠান বণিক স্টোর। প্রতিষ্ঠানটি নিজেরা যেমন এসব মেশিনারিজ তৈরি করে, তেমনি ভারত, চীন, ইতালি ও থাইল্যান্ড থেকেও আমদানি করে। তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৮০ শতাংশ মেশিনারিজই আমদানি করা হয় ভারত থেকে।
প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ভবেশ কুমার বণিক বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান আধুনিক যুগে স্বর্ণালঙ্কার তৈরির বিভিন্ন আধুনিক মেশিন আছে। দেশের বড় বড় শহরের বিভিন্ন জুয়েলারি দোকানে গহনা সেসব আধুনিক মেশিনারিজ থাকলেও মফস্বল শহরগুলোতে এখনো সনাতন পদ্ধতিতেই গহনা তৈরি করা হয়। সনাতন পদ্ধতিতে গহনা তৈরি করলে একদিকে যেমন সময় বেশি লাগে, তেমনি স্বর্ণেরও অনেকটা ক্ষয় হয়। প্রতি ভরিতে প্রায় ৬-৭ শতাংশ স্বর্ণ নষ্ট হয়। কিন্তু আধুনিক মেশিনের মাধ্যমে করলে নষ্ট হয় মাত্র ২ শতাংশ। এতে অনেকটা স্বর্ণ সাশ্রয় হয়। স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা যাতে এসব মেশিনারিজ সম্পর্কে জানতে পারে তাই এই প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া।
তুরস্কের প্রতিষ্ঠান গুভেনিস এই প্রদশনীতে অংশ নিয়েছে। তারা চুড়িসহ বিভিন্ন গহনা গোলাকৃতির করার রোলিং মেশিন ও জুয়েলারি প্যাকেট করার প্যাকিং মেশিন তৈরি করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয় প্রতিনিধি ওসমান বলেন, বাংলাদেশে এখনো সনাতন পদ্ধতিতে হাতে গহনা তৈরি ও প্যাকেটজাত করে। তারা আধুনিক মেশিন সম্পর্কে তেমন জানে না। তারা যেন আধুনিক মেশিনের মাধ্যমে এসব কাজ করতে পারে, সেটি সম্পর্কে জানতেই এই প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া।
জুয়েলারির বিভিন্ন মেশিনারিজ তৈরি করে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান অমর মেশিন টুলস। বাংলাদেশে এই প্রতিষ্ঠানটির পরিবেশক অভি ডাইস কাটার। এই দুই প্রতিষ্ঠানের দেখা মেলে প্রদর্শনীতে। অভি ডাইস কাটারের স্বত্বাধিকারী অটল কর্মকার বলেন, এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে আমরা যেমন আমাদের মেশিনগুলো সম্পর্কে দর্শনার্থীদের জানতে পারছি, তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়ায় তাদের মেশিনারিজ সম্পর্কেও আমরা জানতে পারছি। এতে উভয় পক্ষই লাভবান হচ্ছে। শুরুর দিন থেকেই দর্শনার্থীদের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। আগামীতে এই ধরনের আরও প্রদর্শনী হলে অচিরেই দেশের স্বর্ণশিল্প আধুনিক হয়ে উঠবে।
দিনাজপুর থেকে খালুর সঙ্গে আন্তর্জাতিক জুয়েলারি মেশিনারিজ প্রদর্শনী দেখতে এসেছেন রাহাত রেজওয়ান। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে তার খালুর নকশা জুয়েলার্স নামের গহনার দোকান রয়েছে। রাহাত বাংলানিউজকে বলেন, বাজুসের মাধ্যমে এই প্রদর্শনীর কথা জানতে পেরেছি। জুয়েলারি শিল্পের নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে এই প্রদর্শনীতে এসেছি। প্রদর্শনী ঘুরে যা দেখলাম, তাতে মনে হলো, এসব মেশিনারিজ দিয়ে গহনা তৈরি করলে কাজটা অনেক সহজ হবে। দেশের স্বর্ণশিল্পে নতুন অধ্যায় শুরু হবে।
লক্ষ্মীপুরে অভি শিল্পালয় নামের জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে বিকাশ দাসের। তিনিও এই প্রদর্শনী দেখতে এসেছেন। বিকাশ বাংলানিউজকে বলেন, এখন আমরা হাতেই গহনা তৈরি করি। কিন্তু ক্রেতারা আমাদের কাছে মেশিনের কাজ চায়। তাই এই প্রদর্শনী ঘুরে দেখতে এলাম কেমন মেশিনারিজ আছে। আমরা কী ধরনের মেশিন ব্যবহার করতে পারি, এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। যা আগামীতে কাজে লাগবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৪ ঘণ্টা, জুলাই ০৫, ২০২৪
এসসি/এইচএ/