ঢাকা, রবিবার, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩১, ২৮ জুলাই ২০২৪, ২১ মহররম ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

সহিংসতায় দেশের অর্থনীতিতে আস্থার সংকটসহ ক্ষতি ১ লাখ কোটি টাকার

গৌতম ঘোষ,  সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০২৪
সহিংসতায় দেশের অর্থনীতিতে আস্থার সংকটসহ ক্ষতি ১ লাখ কোটি টাকার অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর ও সেলিম রায়হান

ঢাকা: দেশে চলমান সহিংসতা ও কারফিউর কারণে গত এক সপ্তাহের বেশি কিছু সময়ে সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা মনে করেন, অর্থনীতির ক্ষতির পাশাপাশি সরকারের রাজনৈতিক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।

 

একই সঙ্গে সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, বায়ার ও বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এজন্য সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে রাজনৈতিকদল ও ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনায় বসে সমস্যার সমাধান করতে হবে।  

প্রসঙ্গত, গত ১৪ জুলাই থেকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সারা দেশে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় বহু হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি বিজিবি নামানো হয়। একপর্যায়ে সরকার গত শুক্রবার রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে। একই দিনে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়। এখনো বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। প্রথম দিন দুই ঘণ্টা বিরতি দিয়ে কারফিউ চলে। পরদিন তিন ঘণ্টা বিরতি দেওয়া হয়। গতকাল ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জে চার ঘণ্টা বিরতি দেওয়া হয়। যদিও সারা দেশে জেলাভেদে এই বিরতি কম-বেশি আছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে ঘটে যাওয়া সহিংসতা ও চলমান কারফিউতে আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়েছে আস্থাহীনতার সংকট। এখনও সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। যতদিন পর্যন্ত দেশ স্বাভাবিক জায়গায় যেতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত এই অর্থনীতির ক্ষতিটা চলতেই থাকবে। এজন্য রাজনৈতিক যে বিষয়গুলো সাংঘর্ষিক সেগুলো যতটা দ্রুত সম্ভব কমাতে হবে। তবে সরকার যে নীতিতে চলছে সেটা বর্তমান পরিস্থিতিকে সাময়িক নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে। দীর্ঘমেয়াদি কিছু করতে হলে বিভিন্ন ছাত্রসহ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। সরকারকে শিখতে হবে, শুনতে হবে ও বুঝতে হবে। তারপর কাজ করতে হবে জনগণ কি চায় সেটাকে প্রাধান্য দিতে হবে। তাহলে আস্থার পরিবেশ ফিরে আসবে, যারা ব্যবসা করেন তারা স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ফিরে আসতে পারলে সংকটের জায়গা কমবে।  

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এই নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বাংলানিউজকে বলেন, গত এক সপ্তাহের বেশি কিছু সময়ে আমাদের হিসাবে সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। এখনও কারফিউ চলমান আছে কতদিন চলবে জানি না, মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যাও কাটেনি ফলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। আমাদের বিনিয়োগ কমে গেছে, বিদেশি বিনিয়োগও আগামীতে বাড়বে কিনা সেটা বলা যাচ্ছে না। আর অর্থনৈতিক সূচকগুলো কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে সেটা নির্ভর করছে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর।  

আহসান এইচ মনসুর বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের প্রথম কর্তব্য হলো দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল করা। এটা না করতে পারলে দেশের অর্থনীতির দিকে নজর দিতে পারবে না। এর ফলে চলমান সমস্যা আরও প্রকট হয়ে যাবে। এর জন্য যেটা দরকার সেটা হলো আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টাকে নিষ্পত্তি করা। সরকারকে শুধু নিরাপত্তার কথা চিন্তা করলে হবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতির যে খাতগুলো জটিল হয়ে গেছে সেদিকেও নজর দিতে হবে। সেটা ভুলে গেলে চলবে না। সরকারের উচিত এ খাতটাকে নিয়ে আরও চিন্তাভাবনা করা।

তিনি বলেন, কারফিউ থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠান অনেকদিন বন্ধ ছিল তারা ডিফল্টডার হয়ে যেতে পারে। শ্রমিকদের বেতন ভাতা নাও দিতে পারে অথবা বন্ধ করেও দিতে পারে। সেসব প্রতিষ্ঠানকে প্রটেক্ট করতে হবে কীভাবে করবে সেটা সরকার ভালো জানে। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করে সেটা ঠিক করতে হবে।  

এই গবেষক বলেন, গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দেশের মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। এছাড়া অর্থনীতির যে সব খাতে আমরা উন্নতির আশা করেছিলাম সেটা করতে আরও দেরি হবে। আপাতত দৃষ্টিতে সমস্যা শেষ হলেও এই সমস্যাটা আরও এক দেড় মাস টেনে নিতে হবে। আর সরকারের বিদেশি অর্থায়ন, সংগ্রহ, বিনিয়োগ এগুলো কঠিন হয়ে যাবে। এজন্য নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে সরকারকে। চলমান অভিযান, ধরপাকড় এই ইস্যুগুলো সামনে আসবে। সরকারকে এসব বিষয়ে আমলে নিতে হবে। কীভাবে করবে জানি না, তবে বিভিন্ন দিক থেকে নিরপেক্ষ তদন্ত করার জন্য চাপ আসতেছে।

তিনি বলেন, সরকার রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে গেছে, দেশের জনগণের নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে সেটা তো দুর্বলতারই লক্ষণ। সরকার যে নীতিতে চলছে সেটা বর্তমান পরিস্থিতিকে সাময়িক নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে। দীর্ঘমেয়াদি কিছু করতে হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। কারণ সমস্যাটা তো সামাজিক, অর্থনৈতিক ও দুর্নীতি এ সব কিছুর বর্হিপ্রকাশের কারণেই হয়েছে। শুধু কোটা ইস্যু নয়, এর সঙ্গে জনগণের ক্ষোভও রয়েছে।  

আলোচনাটা কোটা ইস্যু দিয়ে শুরু করতে হবে এরপর সবক্ষেত্রে নজর দিতে হবে। এই বিগত কয়েকদিনে কি ঘটলো সেটা থেকে সরকারকে শিখতে হবে, শুনতে হবে ও বুঝতে হবে। তারপর কাজ করতে হবে জনগণ কি চায় সেটাকে প্রাধান্য দিতে হবে।

এ বিষয়ে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বাংলানিউজকে বলেন, বিগত কয়েকদিন দেশের যে অবস্থা ছিল এতে মোটামুটি দেশের সব কিছু বন্ধ ছিল। সেটার একটা প্রভাব তো দেশের অর্থনীতিতে পরবে। তাছাড়া এখনও সব কিছু স্বাভাবিক হয়নি, ইন্টারনেট পাওয়া যাচ্ছে না ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত রয়েছে। বিশেষ করে ইন্টারনেট ও ডিজিটাল টেকনোলজি সংশ্লিষ্ট যেসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড রয়েছে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সহিংসতা ও কারফিউর কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ ছিল। এখন সেগুলো পূর্ণ দমে কতটুকু আসতে পেরেছে সেটা দেখার বিষয়।  

তিনি বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক এ অস্থিতিশীলতা যদি দীর্ঘদিন থাকে তাহলে দেশি বিনিয়োগকারীর পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও চলে যাবে। কারণ তারাও আস্থার সংকটে ভুগবে যেটা আমাদের অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। রপ্তানিকারকদের অনেক অর্ডার বাতিল হয়েছে, নতুন কোনো অর্ডার পাচ্ছে না। বায়াররাও বাংলাদেশকে নিয়ে পুনঃবিবেচনা করবে। এসব বিষয় নিয়ে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির একটা বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেছে। সংখ্যার হিসেবে আমরা এটা দেখতে পারবো। কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়েছে আস্থাহীনতার। এখনও সাধারণ মানুষ থেকে ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। যতদিন পর্যন্ত দেশ স্বাভাবিক জায়গায় যেতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত এই অর্থনীতির ক্ষতিটা চলতেই থাকবে।  

এই গবেষক বলেন, সরকার বা রাজনীতিবিদরা কেন আগে থেকে এ সমস্যাটা অনুধাবন করতে পারলেন না। তাহলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো এর দায় কার ওপর বর্তায়। সরকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ওপরই দায়টা যাবে। বিশেষ করে সরকারের ওপর বেশি যাবে। কারণ দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে সরকার। আমি আশা করবো এই রাজনৈতিক সহিংসতা কমে আসবে।  

এদিকে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি অফিস গত বুধবার থেকে চার ঘণ্টার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাগুলোও খুলে দেওয়া হয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে সীমিত পরিসরে ইন্টারনেট চালু করা হয়েছে। সড়ক, মহাসড়কগুলোয় যান চলাচল ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫১ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০২৪
জিসিজি/আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।