ট্যানারি শিল্প আর হাজারিবাগে থাকছে না। রাজধানীর অদূরে সাভারে বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে চামড়ানগর।
ঢাকা: প্রস্তাবিত চামড়া শিল্পনগরের সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল গত মার্চে। এরপর সময় বাড়ানো হয় জুন পর্যন্ত। তাতেও কাজ শেষ হয়নি। এখন নতুন করে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেপ্টেম্বর। কিন্তু অগ্রগতি সামান্যই।
শ্রমিকরা জানিয়েছে, যেভাবে কাজ চলছে তাতে আরো দুই সেপ্টেম্বরেও শেষ হবে না কাজ। তবে কর্মকর্তাদের দাবি, আসছে ডিসেম্বরের মধ্যেই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে।
সম্প্রতি সাভার শিল্পনগর এলাকায় সরেজমিন প্রতিবেদনে যায় বাংলানিউজ। প্রকল্প এলাকা ঘুরে কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক কর্মচারী ও প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে তুলে আনে বিস্তারিত তথ্য।
সিইটিপি কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে সাভার ট্যানারি শিল্পনগর প্রকল্পের পরিচালক সিরাজুল হায়দার বাংলানিউজকে জানান, চারটি মডিউলে কাজ হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে দুটি মডিউলের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর কাজ অনেকাংশেই শেষ হয়েছে। এখন চলছে ইলেকট্রো মেকানিক্যালের কাজ। বলা যায় সিইটিপি’র ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বাকী কাজ চলতি বছরের মধ্যেই শেষ হবে আশা করছি। তবে কিছু সমস্যা তো রয়েছেই।
তিনি বলেন, আমাদের টার্গেট ছিলো জুনের মধ্যে কাজ শেষ করা, সেটি হয়ে উঠেনি। আশা করছি সেপ্টেম্বরের মধ্যে অন্তত দুটি ইউনিট চালু করা যাবে। তবে পুরা ইউনিট ডিসেম্বরের আগে চালু করা সম্ভব হবে না।
সিইটিপি নির্মাণকাজে সংশ্লিষ্ট বিসিকের প্রকৌশলী মো. মইনুদ্দিন প্রকল্প এলাকায় কাজের অগ্রগতি তুলে ধরে বাংলানিউজকে বলেন, সরকারি প্রজেক্টে এতো দ্রুত কাজ শেষ হওয়ার নজির নেই। গত বছর (২০১৪) এই প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হয়। বর্তমানে কাজের ৭০ শতাংশই শেষ। এখন শুধু মেশিন ইনস্টলেশন বাকী। তবে মেশিনও চলে এসেছে।
সাভার সিইটিপি’র প্রতিদিন বর্জ্য পরিশোধন ক্ষমতা থাকছে ২৫ হাজার কিউবিক মিটার। আর বিসিক থেকে সাভারের ১৫৫টি ট্যানারির উৎপাদিত বর্জ্য ধরা হয়েছে ২০ হাজার কিউবিক মিটার।
প্রকল্প এলাকা ঘুরে নির্মাণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চামড়ায় ব্যবহৃত ক্যামিকেল নষ্ট করার জন্য দুটি ভাগে ৮টি অক্সিডাইজেশন বক্স থাকবে। চারপাশে উঁচু দেওয়ালের মাঝে কুপের মতো করে তৈরি এসব অক্সিডাইজেশন বক্স।
ট্যানারি বর্জ্য প্রথমে পাইপ লাইনের মাধ্যমে যাবে ব্রাইটেক্স চেম্বারে। সেখান থেকে রিফাইন হয়ে সলিট চেম্বারে যাবে। এরপর ইকুলাইজেশন ট্যাংক থেকে যাবে অক্সিডাইজেশন বক্স ‘এ’ তে। এরপর অক্সিডাইজেশন বক্স ‘বি’ হয়ে যাবে স্ল্যাম রিয়েল ট্যাংকে। সর্বশেষে বর্জ্য যাবে ডাম্পিং মেশিনে। বিষমুক্ত তরল চলে যাবে ধলেশ্বরী নদীতে। আর ডাম্পিং এর বর্জ্য দিয়ে তৈরি হবে বিদ্যুৎ। এখানকার প্রক্রিয়ায় যে বিদ্যুৎ খরচ হবে তা নিজস্ব পাওয়ার স্টেশন থেকেই মেটানোর চিন্তাভাবনা রয়েছে।
এদিকে ট্যানারি থেকে যে পাইপ লাইনের মাধ্যমে বর্জ্য সিইটিপিতে যাবে সেই পাইপ লাইনের কাজ সবে শুরু হয়েছে। দুই তিন মাস আগে থেকে এখানে পাইপ নিয়ে আসা হয়, প্রকল্প এলাকায় স্তুপ আকারে পাইপ রাখা হয়েছে। যেভাবে পাইপ লাইন স্থাপনের কাজ চলছে তাতে আরো ৬ মাস লাগবে বলে জানান শ্রমিকরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফিনিশড্ লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএলএলএফইএ) সভাপতি আবু তাহের বাংলানিউজকে বলেন, কারখানা নির্মাণের কাজ আরও বেগবান হতো, কিন্তু আমরা টাকা পাচ্ছি না। আমরা ব্যাংককে বলেই যাচ্ছি ঋণের জন্য, কিন্তু পাচ্ছি না। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আশা দিয়েছে- আমাদের লোন দেবে, লোন পেলে দ্রুতই সিফট করা যাবে।
তিনি বলেন, ট্যানারি মালিকদের চাপ দিয়ে লাভ নেই। সিইটিপি নির্মাণ না হলে ট্যানারিতে এসে তো কাজ করা যাবে না। আমাদের অন্তত ২০টি ট্যানারি কাজ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এখন সিইটিপি চালু হলেও আমরা আসতে পারি।
ডিসেম্বরের মধ্যে সিইটিপি নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন ট্যানারি মালিকদের এই নেতা।
এ বিষয়ে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবার) নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বাংলানিউজকে বলেন, সিইটিপি নিয়ে ট্যানারি মালিকরা অযুহাত দেখাচ্ছেন। সিইটিপি হোক না হোক তাদের তো হাজারীবাগ থেকে সেখানে চলে যেতে বাধা নেই। তারা বলছেন, সিইটিপি না হলে গিয়ে লাভ কি? তাহলে তাদের প্রতি প্রশ্ন রেখে বলতে চাই- যদি সিইটিপি নির্মাণ হয়ে যায় তখন যদি ট্যানারি মালিকরা আসতে না পারেন তাহলে এই বায়োক্যামিকেল মেশিন নষ্ট হয়ে যাবে। তখন কে ক্ষতিপূরণ দেবে? সরকারের কোটি টাকার প্রজেক্ট নষ্ট হবে। সিইটিপি চালু করতে হলে আগে ট্যানারি মালিকদের শিফট করতে হবে।
তিনি বলেন, এপেক্স, ঢাকা ট্যানারি লিমিটেড, বে কোম্পানির মতো বড় ট্যানারি সাভারে শিফট না হলে সিইটিপি চালু করা কষ্টকর হবে। তাই সরকারের উচিত নির্ধারিত সময়ে সিইটিপি নির্মাণের পাশাপাশি ট্যানারি মালিকদের চাপ দেওয়া।
সাভারের বলিয়াপুরে ২০০ একর জায়গা জুড়ে পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগর গড়ে তোলা হচ্ছে। এর মধ্যে সাড়ে ১৭ একর জায়গায় নির্মাণ করা হচ্ছে শুধু সিইটিপি। ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট একনেকে চামড়া শিল্পনগর প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০০৫ সালে। কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় দফায় দফায় সময় ও ব্যয় বাড়ে। এই শিল্পনগরে ২০৫টি প্লটে ১৫৫টি কারখানা স্থাপন করা হবে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রিলায়েন্স, আজমীর ট্যানারির দ্বিতল ভবন সম্পন্ন হয়েছে। রিলায়েন্সের ৯টি ড্রামও বসানো হয়েছে। এরকম ১৫টির মতো ট্যানারির অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছে। বরাদ্দকৃত ১৫৫টি ট্যানারির মধ্যে প্রায় সবগুলোই ৬ তলাবিশিষ্ট শিল্পভবন হওয়ার কথা থাকলেও একটিরও তিন তলার বেশী সম্পন্ন হয়নি। এ অবস্থায় চলতি বছরেই হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের টার্গেট নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০১৫
এসএম/জেডএম
অর্থনীতি-ব্যবসা
চামড়ানগরে সরেজমিন-১
আরও দুই সেপ্টেম্বর লাগবে
শাহজাহান মোল্লা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।