ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি

ট্রাস্ট লাইফে অনিরাপদ গ্রাহকের টাকা!

সাঈদ শিপন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৫
ট্রাস্ট লাইফে অনিরাপদ গ্রাহকের টাকা!

ঢাকা: চরম অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে নতুন অনুমোদন পাওয়া ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্সে। অনুমোদনের পর ২ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রতিষ্ঠানটিতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি।



সিইও বিহীন এই জীবন বিমা কোম্পানিটিতে ‘পাগলা ঘোড়া’র মতো ছুটছে খরচে হিসাব। এমনকি যে পরিমাণ আয় হচ্ছে তার থেকে ব্যয় হচ্ছে বেশি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মকর্তা নিয়োগের কাঠামোতেও কোনো নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। ফলে ব্যবসার শুরুতেই আর্থিক ভিত্তি অত্যেন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। এতে গ্রাহকের টাকাও অনিরাপদ হয়ে পড়ছে ট্রাস্ট লাইফে।

সূত্রমতে, পরিশোধিত মূলধন থেকে চার কোটি টাকা উত্তোলন করেও প্রতিষ্ঠানটির হাতে নগদ অর্থ আছে মাত্র ৩ লাখ টাকা। আর ব্যাংকে জমা আছে ২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। অথচ ৬ মাস আগেও প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংকে জমা অর্থ ছিলো ৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। অর্থা‍ৎ দিন দিন ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা।

ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রেও নানা অনিয়ম করছে নতুন অনুমোদন পাওয়া এই বিমা প্রতিষ্ঠানটি। কোম্পানির এজেন্টদের সংখ্যা, প্রিমিয়াম আয়, উন্নয়ন কর্মকর্তা, ব্যবস্থাপনা ব্যয়সহ প্রতিটি স্তরেই অনিয়মে নিমজ্জিত ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ।

চলতি বছরের প্রথম ৬ মাস (জানুয়ারি থেকে জুন) শেষে প্রস্তুত করা আর্থিক বিবরণীতে দেখা যায়, এই সময়ে ব্যবসা (প্রিমিয়াম আয়) হয়েছে ৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা। আর এই ব্যবসা সংগ্রহ করতে ব্যয় হয়েছে ৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।

অর্থাৎ কোম্পানিটির আয়ের থেকে ব্যয় বেশি। ২০১৪ সালেও ছিলো একই চিত্র। ওই বছর ১১ কোটি ২৯ লাখ টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় হয়েছিলো ১৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।

চলতি বছরের ব্যবসার মধ্যে নতুন ৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা এবং নবায়ন মাত্র ৪৩ লাখ টাকা। অথচ আগের বছর ২০১৪ সালে নতুন ব্যবসা হয়েছিলো ১১ কোটি ২৭ লাখ টাকা। অর্থা‍ৎ আগের বছরের সিংহভাগ ব্যবসা নবায়নে আদায় হয়নি।

তামাদি (ল্যাপস) পলিসির চিত্রেও রুগ্ন  অবস্থা বিরাজ করছে প্রতিষ্ঠানটির। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ৩ হাজার ৬৫৪টি পলিসি বিক্রি করেছে। এর বিপরীতে এই সময়ে পলিসি তামাদি হয়েছে ৩ হাজার ৩৬২টি।

জীবন বিমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্রাস্ট লাইফের আয়-ব্যয় ও তামাদি পলিসির যে চিত্র বিরাজ করছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, এক শ্রেণীর কর্মকর্তা ভুয়া পলিসি বিক্রি দেখিয়ে কমিশন বাবদ কোম্পানি থেকে টাকা উঠিয়ে নিচ্ছে। অথবা গ্রাহককে ঠকাতে ইচ্ছা করেই পলিসি তামাদি করছে। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে কোম্পানির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।

এদিকে জীবন বিমা কোম্পানিতে এমপ্লয়ার অব এজেন্ট ও এজেন্ট’র আদর্শ অনুপাত ১:১৮। অর্থ‍াৎ একজন এমপ্লয়ার অব এজেন্ট থাকলে এজেন্ট থাকবে ১৮ জন।

অথচ এই প্রতিষ্ঠানটিতে এজেন্ট আছে ২৪২ জন, এর বিপরীতে এমপ্লয়ার অব এজেন্ট ২৩৭ জন। অন্যান্য কর্মকর্তাদের চিত্রও আশ্চর্যজনক। ট্রাস্ট ইসলামী লাইফে স্টাফ আছে ২৮জন। আর স্টাফ সুপারভাইজারি পদে আছে ৭৪৪ টি!

যোগাযোগ করা হলে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের পরিচালক মো. জিল্লুর রহমান মৃধা বাংলানিউজকে বলেন, আমি পরিচালক হিসেবে আছি, তবে কোম্পানি সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। শুধু পর্ষদ সভায় অংশ নিই। কিন্তু গত দুই পর্ষদ সভায় আমি ছিলাম না। আপনি পরিচালক জাহাঙ্গীর সাহেহের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

এরপর পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর হোসাইন মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এখনও পূর্ণাঙ্গ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে ভারপ্রাপ্ত সিইও আছেন।

তবে প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের চিত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।

এদিকে কোম্পানিটির অনুমোদনের ক্ষেত্রেও নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা করেনি বিমা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। ফলে আইনের শর্ত না মেনেই আবেদন করে নিবন্ধন সনদ পেয়েছে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ।

বিমা আইন অনুযায়ী, কোনো বিমা কোম্পানিতে এক পরিবার থেকে দুই জনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবে না। আর একই পরিবার থেকে দু’জন পরিচালক থাকলে তাদের সম্মিলিত শেয়ার ধারনের পরিমাণ ১০ শতাংশের বেশি হতে পারবে না।

অথচ ট্রাস্ট ইসলামী লাইফে এক পরিবার থেকেই রয়েছেন ৪ পরিচালক। আর তাদের সম্মিলিত শেয়ার ধারনের পরিমাণ ২১ শতাংশের বেশি।

চার পরিচালকের মধ্যে দুই ভাই জাকের আহমেদ ভূঁইয়া ও মোহাম্মদ রাকিব আহমেদ। অপর দু’জন তাদের আর এক ভাই জয়নাল আবেদিন জাফরের স্ত্রী শওকত আরা বেগম ও তার ছেলে রাসেদ আবেদিন।

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে আইডিআরএ-এর সদস্য মো. কুদ্দুস খানের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যস্ততার কথা বলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

আর আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ দেশের বাইরে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

পরিচালকদের বিষয়ে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের পরিচালক জাহাঙ্গীর বাংলানিউজকে বলেন, একই পরিবার থেকে ৪জন পরিচালক থাকার তথ্য আপনার কাছে থাকলে থাকতেও পারে, আমার কাছে নেই।

বাংলাদেশ সময়: ০৮১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৫
এএসএস/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।