ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

আসছে তাপসহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল গম ও ভুট্টার জাত

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৫
আসছে তাপসহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল গম ও ভুট্টার জাত

ঢাকা: বাংলাদেশে প্রতি বছর গমের চাহিদা ৪৫ লাখ টন। এর বিপরীতে উৎপাদিত হয় মাত্র ১৩ লাখ টন।

তাই প্রতি বছর ব্রাজিলসহ নানা দেশ থেকে গম আমদানি করতে হয়। আমদানি নির্ভরতা কমানো এবং চাহিদা অনুসারে দেশেই গম ও ভুট্টার উৎপাদন বাড়ানোর এক মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বারি)।   সে লক্ষ্যে  কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থাটিতে তাপসহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল গম ও ভুট্টার নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। এতে করে অতি উষ্ণতায়ও বাড়তি ফলন মিলবে গম ও ভুট্টার।

গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও।

দীর্ঘ শীতকাল দরকার গম উৎপাদনের জন্য। এ অবস্থা বাংলাদেশে এক সময় ছিল, কিন্তু  এখন আর নেই। অতিরিক্ত তাপ সহ্য করতে পারে না গম ও ভুট্টা। তাই তো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও আবহাওয়ার পরিবর্তনে বাংলাদেশে শীতের স্থায়িত্ব কমার জন্য গত ১৫ বছরে গমের উৎপাদন কমে গেছে ৬ লাখ টন। তাই বলে তো বাংলাদেশের অন্যতম খাদ্যশস্য গম ও ভুট্টার আবাদ থেমে থাকতে পারে না।  

বারি সূত্র জানায়,  তাপসহিষ্ণু ও উচ্চ ফলনশীল জাত বারি গম ২৭ ও বারি গম ২৮সহ ভুট্টার ২০টি ইনব্রিড লাইন ও একটি বেবিকর্নের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এছাড়া গমের নতুন জাতগুলোর ২১০ টন প্রজনন বীজ উৎপাদন ও ৩১০ টন মানসম্পন্ন বীজ উদ্ভাবন করা হয়েছে। এগুলোকে নিয়ে আরও বড় পরিসরে গবেষণা করা হবে।
 
অন্যদিকে ভুট্টার ইনব্রেড লাইনের ৪০ টন, হাইব্রিড ভুট্টার ৬ টন এবং ‍মুক্ত পরাগায়িত ৬ টন বীজ উৎপাদন করা হয়েছে।
 
দেশে ৪ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে গমের আবাদ হয়। প্রতি হেক্টরে গমের বীজ প্রয়োজন ১২০ কেজি। কিন্তু মানসম্মত গমের বীজ পাচ্ছেন না চাষিরা। এতে করে ফলন দিন দিন কমে যাচ্ছে। সে লক্ষ্যেই আসছে তাপসহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল গম ও ভুট্টার জাত।
 
বারি’র পরিচালক (গম গবেষণা কেন্দ্র) ড. মুহাম্মাদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রতি বছর ৩০ থেকে ৩১ লাখ টন গম আমদানি করতে হয়। চাষিরা উন্নতমানের গম ও ভুট্টা বীজ না পাওয়ার কারণে ফলন বাড়ছে না। অনেক চাষি যেন-তেন গমবীজ ব্যবহার করছেন, মানসম্মত বীজ পাচ্ছেন না। সেজন্যই আমরা তাপ ও লবণসহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল গম ও ভুট্টার জাত উদ্ভাবন করছি’।

‘ফলন বাড়ার লক্ষ্যে আমরা গমের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করছি। পর্যায়ক্রমে এগুলো চাষিদের মাঝে বিতরণ করা হবে। নতুন জাতের এসব বীজের মাধ্যমে গম ও

ভুট্টার ফলন বাড়বে। দেরিতে গম ও ভুট্টা চাষ করা হলেও ফলন ভালো হবে।   রোগ বালাইও কম ধরবে এসব উন্নত জাতে’।
‘গম ও ভুট্টার উন্নততর বীজ উৎপাদন এবং উন্নয়ন (দ্বিতীয় পর্যায়ে)’ চলমান প্রকল্পের আওতায় গম ও ভুট্টার জাতগুলো উৎপাদন করা হয়েছে। ১৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন মেয়াদে জাতগুলো উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। চলমান প্রকল্পটি শেষ হবে ২০১৯ সালের জুন নাগাদ। গম ও ভুট্টার ‍উৎপাদন ভালো হয় সাতটি বিভাগের ১০১টি উপজেলায় প্রকল্পটি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হবে।

 গম ও ভুট্টার জাত উদ্ভাবনে একগুচ্ছ কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এতে করে আরও উন্নত জাতের গম ও ভুট্টার বীজ আসবে কৃষি বিপ্লবের জন্য। গম ও হাইব্রিড ভুট্টার উন্নততর ও উচ্চ ফলনশীল জাতের উদ্ভাবন, অধিক ফলন প্রাপ্তির লক্ষ্যে গম ও ভুট্টার উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সংরক্ষণে উন্নত প্রযুক্তিরও আবিষ্কার করা হবে।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় চাষিদের পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রজনন বীজ  এবং ভুট্টার ইনব্রিড লাইনগুলোর বীজ বিতরণ করা হবে।

উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলো প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী, মাঠ দিবস, প্রকাশনা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে চাষিদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ ও ভিজিটের মাধ্যমে কৃষক, মাঠকর্মী ও বিজ্ঞানীদের জ্ঞান-দক্ষতারও উন্নয়ন করা হবে। সর্বোপরি মানসম্মত বীজ উৎপাদন জোরদারকরণ এবং গম–ভুট্টার জাত ও অন্যান্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশে গম ও ভুট্টার উৎপাদন বৃদ্ধি করা হবে।

নানা কারণে প্রকল্পটিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গম বাংলাদেশে দ্বিতীয় প্রধান দানাশস্য হিসেবে খাদ্য নিরাপত্তায় যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। নতুন নতুন উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন, উন্নতমানের বীজ উৎপাদন, কৃষক প্রশিক্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে গম ফলন আরও বাড়ানো সম্ভব।

অন্যদিকে পশুখাদ্য হিসেবে ভুট্টার বহুল ব্যবহার বাড়ছে। বর্তমানে তৃতীয় প্রধান দানাশস্য হিসেবে ভুট্টা গুরুত্বপূর্ণ ফসল এবং দিন দিন দেশে এর আবাদ বাড়ছে।

সাম্প্রতিককালে দেশে পোলট্রি ও মৎস্য খাতের দ্রুত প্রসার হচ্ছে। মূলত পোলট্রি ও মৎস্য খাদ্যে ভুট্টার চাহিদার কারণেই উৎপাদন বাড়ানোর মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। দানাশস্য বীজ উৎপাদনকারীকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্রিডার বীজ সরবরাহ করার লক্ষ্যে আরো কর্মসূচির প্রয়োজন।   এছাড়া অগ্রসর কৃষক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও মাঠ প্রদর্শনীর কাজে ব্যবহারের জন্য নতুন নতুন তাপসহিষ্ণু জাতের বীজ প্রয়োজন।
 
এর আগে স্বল্প পরিসরে ‘গম ও ভুট্টার উন্নততর বীজ উৎপাদন এবং উন্নয়ন (প্রথম পর্যায়ে)’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১০ সালের মার্চ থেকে ২০১৪ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়িত হয়েছে। বারি এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)  এ প্রকল্পে ৫৯৭ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। প্রকল্পের আওতায় গমের দু’টি এবং ভুট্টার দু’টি হাইব্রিড জাক ও ২০টি ইনব্রিড উদ্ভাবন করা হয়। এছাড়া প্রকল্পের বিভিন্ন কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি অবকাঠামো উন্নয়ন, মাঠ ও ল্যাবরেটরি যন্ত্রপাতি ক্রয়, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, গ্রিন হাউজ স্থাপন কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে।

এ প্রকল্পের সফলতার আলোকেই বড় পরিসরে নানা উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বারি।

বারি সূত্র জানায়, গমের সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছিল ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে প্রায় ১৯ লাখ ৮ হাজার টন। অথচ দীর্ঘ সময় পর  ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে গমের উৎপাদন দাঁড়ায় মাত্র  ১৩ লাখ টন। বিগত ১৫ বছরে যেখানে জনসংখ্যা বেড়েছে ২৬ শতাংশ, সেখানে গম উৎপাদন কমেছে ৩২ শতাংশ। এ ব্যবধান কমাতেই তাপসহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল গম ও ভুট্টার জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। এতে আগের মতোই গম ও ভুট্টার উৎপাদন বাড়বে বলে আশা করছে বারি ও বিএডিসি।
 
বাংলাদেশ সময়: ০০০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৫
এমআইএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।