ঢাকা: বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের দাপটে আবাসিক ঐতিহ্য/রূপ হারাচ্ছে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা।
দেশ স্বাধীনেরও আগে ১৯৫২ সালে সুবিশাল পাঁচ শ’ একর জমিতে ১০৮৩টি প্লট নিয়ে ‘ধানমন্ডি’ আবাসিক এলাকা হিসেবে যাত্রা শুরু করে।
তারা জানাচ্ছে, ধানমন্ডিতে শতকরা ৫২ ভাগ ভবন আবাসিক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও ৪৮ শতাংশ ভবন জুড়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, অফিস, দোকান ও শপিং মল। যা দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ব্যাখ্যা
ধানমন্ডি ১ নম্বর সড়ক থেকে ২৭ (পুরাতন) নম্বর পর্যন্ত মোট সড়কের সংখ্যা ৩১টি। এই ৩১টি সড়কে মোট ভবনের সংখ্যা ১৫৯২টি। এর মধ্যে নির্মাণাধীন ভবন ১২০। জরিপে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ধানমন্ডিতে বর্তমানে একতলা ভবন রয়েছে ৭৬টি, দোতলা ২৪১টি, তিন তলা ২০০টি, চারতলা ১০৪টি, পাঁচতলা ১২৬টি, ছয় তলা ৬৬৮টি, সাত তলা ২৮টি, আট তলা ১৬টি, নয় তলা ২২টি, দশ তলা ৪১টি, এগার তলা ৭টি, বার তলা ১৪টি, তের তলা ২২টি, চৌদ্দ তলা ২২টি এবং পনের তলা ভবন রয়েছে ৫টি।
একতলা, দোতলা, তিনতলা ভবনগুলো এখন পর্যন্ত একক মালিকানায় রয়েছে। কিছু জমির মালিক নিজেরাই চার, পাঁচ, ছয় তলা ভবন তুলে শরিকদের মধ্যে ভাগাভাগি করে বসবাস করছেন। ধানমন্ডিতে ছয় তলা ভবন রয়েছে সর্বাধিক। ছয় তলা এবং ততোধিক তলা বিশিষ্ট ভবনগুলো যৌথ মালিকানার। অর্থাৎ এসব ভবন ডেভেলপারের মাধ্যমে নির্মাণের পর ফ্ল্যাট অথবা স্পেস হিসেবে বিক্রি করা হয়েছে। এরপর ক্রেতারা কেউ আবাসিক হিসেবে, কেউ বা অফিস হিসেবে, কেউ বা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফ্ল্যাট/স্পেস ব্যবহার করছে, অথবা ভাড়া দিয়েছে।
জরিপে দেখা যায়, ১৫৯২টি ভবনের মধ্যে আবাসিক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ৮২৩টি ভবন। আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ৫৩২টি এবং শুধুমাত্র বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ২৩৭টি ভবন। অর্থাৎ মোট ভবনের শতকরা ৫২ ভাগ আবাসিক, আবাসিক কাম বাণিজ্যিক এবং বাণিজ্যিক মিলে শতকরা ৪৮ভাগ ভবন বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
ধানমন্ডি এলাকায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে মোট ১৩৩টি। এর মধ্যে স্কুল ৪৮টি, কলেজ ১৪টি, মেডিকেল কলেজ ৪টি, ডেন্টাল কলেজ ২টি, বিশ্ববিদ্যালয় ১৬টি, কোচিং সেন্টার ২০টি, ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ৮টি, স্টুডেন্ট কনসাল্টেশন সেন্টার ১৭টি এবং ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে ৪টি।
জরিপে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ধানমন্ডিতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস রয়েছে মোট ১৬৮টি। এর মধ্যে স্কুল ক্যাম্পাস ৯১টি, কলেজ ক্যাম্পাস ২৭টি, মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ ক্যাম্পাস ৬টি ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রয়েছে ৪৪টি।
উল্লেখ্য, পঞ্চাশের দশকে ধানমন্ডিতে মাত্র দু’টি স্কুল ছিল, ধানমন্ডি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় ও ধানমন্ডি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। পিওর আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তখনকার পরিকল্পনায় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অস্তিত্বই ছিল না।
হাসপাতাল ও ডায়গনোস্টিক সেন্টার
জরিপের তথ্যানুযায়ী ধানমন্ডি এলাকায় প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়গনোষ্টিক সেন্টার রয়েছে মোট ৯৯টি। এর মধ্যে হাসপাতাল ৩৫টি, ক্লিনিক ২২টি, ডেন্টাল ক্লিনিক ২৮টি এবং ডায়গনোস্টিক সেন্টার রয়েছে ১৪টি।
ফুড শপ
খাবার ও খাবারজাত প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৭৩টি। এর মধ্যে রেস্টুরেন্ট ১২২টি, ফাস্ট ফুড ৮৪টি, মিষ্টির দোকান ৩১টি, বেকারি ২৫টি এবং বিরিয়ানির দোকান রয়েছে ১১টি।
শপিং মল, মার্কেট, দোকান ও অন্যান্য
জরিপে প্রাপ্ত তথ্যমতে ধানমন্ডিতে শপিং মল ও ছোট পরিসরের মার্কেটের সংখ্যা মোট ২২টি। শপিং মল, মার্কেট এবং বিভিন্ন সড়কে অবস্থিত মোট দোকানের সংখ্যা ১৩৬১টি। এর মধ্যে ওষুধের দোকান ৩৩টি, পোশাকের দোকান ৪২০টি, জুতার দোকান ৫৮টি, মোবাইল ফোনের দোকান ১১২টি, দর্জি দোকান ৯৩টি, লন্ড্রি ২৮টি, বুক স্টেশনারি ৪৩টি, সেলুন ২১টি,অন্যান্য দোকান রয়েছে৪২৮টি।
এছাড়া বিউটি পারলার ৩২টি, ব্যাংকের শাখা ৬২টি, ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউট রয়েছে ৭টি।
ধানমন্ডিতে বর্তমানে কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে ১৩টি, আর্ট গ্যালারি ৬টি, পুলিশ স্টেশন ও পুলিশ বক্স ৩টি, ডিপ্লোমেটিক অফিস ৬টি, মসজিদ ৯টি এবং খেলার মাঠ রয়েছে ৫টি।
খেলার মাঠ
ধানমন্ডিতে খেলার মাঠ রয়েছে ৫টি। এর মধ্যে ২টি বড় ও ৩টি ছোট।
ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান
ধানমন্ডিতে কর্মরত ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা রয়েছে ১৩১টি। তাদের নির্মিত প্রকল্পের সংখ্যা ৪০২টি এবং নির্মাণাধীন প্রকল্পের সংখ্যা ১২০টি।
সর্বাধিক ভবন নির্মাণ করেছে, অথবা নির্মাণাধীন রয়েছে জরিপে এমন ১০টি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- আরবান ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লি. (ইউডিডিএল) ৪৬টি, এডভান্স ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লি. (এডিডিএল) ৩১টি, এ্যাসেট ডেভেলপমেন্ট ৩০টি, আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ ১৬টি, কনকর্ড ১৩টি, সুবাস্তু ১২টি, ডোমিনো ৮টি, সাউথ ব্রিজ ৭টি, এএনজেড প্রোপার্টিজ ৬টি এবং র্যাংগস ৬টি।
জরিপ দলের কাছে স্থানীয় বাসিন্দারা বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। তাদের কমন বক্তব্য, এই এলাকায় ব্যবসা- বাণিজ্যের বিস্তৃতি ঘটায় বিবিধ সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। বহিরাগতদের সমাগম বৃদ্ধি পেয়েছে। এ এলাকায় যানজট বর্তমানে স্থায়ী রূপ নিয়েছে। গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সড়ক দুর্ঘটনা, বায়ু দূষণ ও মাত্রাতিরিক্ত শব্দ দূষণ বেড়েছে। আগের তুলনায় বেড়েছে বখাটেদের উৎপাত, চুরি ও ছিনতাই। মাদকের প্রসার, সামাজিক অনাচার ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আবাসিক ঐতিহ্য হারাচ্ছে ধানমন্ডি- মত এলাকার বাসিন্দাদের।
জরিপ সংশ্লিষ্ট প্রোব টিমে পরিকল্পনার দায়িত্বে ছিলেন প্রধান সম্পাদক ইরতিজা নাসিম আলী। সম্পাদনা করেন আয়েশা কবির। তথ্য সংগ্রহে ছিলেন রঙ্গন মিত্র ও দেবাশীষ সরকার। সমন্বয় হিসেবে কাজ করেন শফিক রহমান। এছাড়া প্রতিবেদন তৈরি করেছেন আনোয়ার পারভেজ হালিম।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০২, ২০১৬
আইএ