ঢাকা: মাত্র ৩৫ টাকায় মাছ বা ডিম, সঙ্গে গিলা কলিজা। ভাত, ডাল ইচ্ছেমতো।
হোটেলের কোণে অন্দর মহল কক্ষে বিক্রি হচ্ছে। স্টাফদের খাবার হলেও নেই স্টাফ। দৈনিক বিক্রি লাখ টাকা। অথচ বছরের পর বছর দেয় না কোনো ভ্যাট!
আবার একই রেস্তোঁরার চারটি ক্যাশ কাউন্টার। বিল নিতে দম ফেলারও যেন ফুরসত নেই। দৈনিক বিক্রি অন্তত ২০ লাখ টাকা। কিন্তু ভ্যাট নেওয়ার নেই কোনো আলামত এখানেও!
একই ভবনে আবাসিক হোটেল। বিদেশিসহ হোটেলে সব সময় থাকে পরিপূর্ণ। সর্বশেষ কবে ভ্যাট দিয়েছেন যেন ভুলেই গেছেন!
রাজধানীর ঠাঁটারিবাজারের হোটেল স্টার গ্রুপের হোটেল স্টার প্রাইভেট লিমিটেডের ভ্যাট ফাঁকির এগুলো নমুনা মাত্র। সোমবার বাংলানিউজকের সরেজমিন চিত্র এটি।
শুধু ঠাঁটারিবাজারই নয়। বনানী, ধানমণ্ডি, ওয়ারি, টিকাটুলি, এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় স্টার গ্রুপের ১১টি প্রতিষ্ঠানে ভ্যাট ফাঁকির যেন মহোৎসব চলছে।
অভিযোগের ভিত্তিতে সোমবার (১৮ এপ্রিল) মূসক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের আটটি টিম এসব প্রতিষ্ঠানে একযোগে অভিযান পরিচালনা করে এর সত্যতা পায়।
ঠাঁটারিবাজারের এ শাখায় গিয়ে দেখা গেছে, নিজস্ব ভবনের নিচতলায় তিনটি ক্যাশ কাউন্টার। ছোট্ট নিজস্ব প্যাডে দেওয়া হচ্ছে বিল, নেওয়া হয় না ভ্যাট।
ইসিআর থাকলেও তা অনুমোদনহীন। ইসিআর চালান দেন, তবে তাতে কোনো ডাটা সংরক্ষিত নেই। ভ্যাট ফাঁকি দিতে প্রতিদিনের বিক্রির ক্যাশ রেজিস্টারও রাখেন না মালিকপক্ষ।
দৈনিক লাখ লাখ টাকার পার্সেলের ক্ষেত্রে ইসিআর, মূসক চালান তো দেনই না। রাখেন না কোনো ক্যাশ রেজিস্টার। এভাবে মাসে কয়েক লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে হোটেল স্টারের শাখাটি।
দ্বিতীয় তলায় এসি ভিআইপি রেস্তোঁরায়ও একই চিত্র। মূসক ও ইসিআর চালান না দিয়ে নিজস্ব প্যাডে বিল নেন। রাখেন না কোন ক্যাশ রেজিস্টার।
সঙ্গেই রয়েছে আবাসিক (ভিআইপি)। প্রায় সময়ই থাকেন বিদেশিরা। অনুমোদনহীন ইসিআর প্রদর্শন করেন, কিন্তু চালান দেননি কখনো। নেই ক্যাশ রেজিস্টার।
২০১৩ ও ২০১৪ সালে ৭৩২ জন বিদেশি এ হোটেলে থাকলেও কোনো ভ্যাট দেয়নি। ভাড়ার ওপর ভ্যাট নিলেও তা জমা দেয়নি হোটেল কর্তৃপক্ষ।
ভ্যাট ফাঁকির এমন চিত্র দেখে হতবাক অভিযানে নেতৃত্বে দেওয়া মূসক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের সহকারী পরিচালক একেএম সুলতান মাহমুদও।
তিনি বাংলানউজকে বলেন, প্রতিদিন অন্তত ২০ লাখ টাকার বেশি বিক্রি করেন। ভ্যাট ফাঁকি দিতে ক্যাশ রেজিস্টার রাখেন না, ইসিআর ও মূসক চালান দেন না।
প্রয়োজনীয় কাগজ বাথরুমের মধ্যেও পাওয়া গেছে। কাঁচা রশিদ, রেজিস্টার, ইসিআর ও প্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক দলিল জব্দ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
অন্যদিকে নিচতলায় একটি গোপন কক্ষে ৩৫ টাকার খাবারের সন্ধান পেয়ে চমকে ওঠেন গোয়েন্দারা। হোটেল কর্মকর্তারা সেটিকে স্টাফদের খাবারের রুম বললেও গিয়েই হতবাক তারা!
প্রতিদিন লাখ টাকা বিকি হয়। ৩৫ টাকা দিলেই দেওয়া হয় একটি স্লিপ। বসা তো দূরের কথা, দাঁড়ানোর জায়গা নেই। কিন্তু এখানকার বিক্রিতে কখনো ভ্যাট দেয়নি কর্তৃপক্ষ।
ভ্যাট ছাড়া বিক্রির কথা জিজ্ঞাসা করতেই ম্যানেজার মিজান বলেন, স্টাফরা খায়। বাইরে ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়, কোনো লাভ হয় না। এটা কোম্পানির লস প্রজেক্ট।
জায়গা সংকটে ভেতরের রুমে আর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট দেওয়া হয় হোটেলের ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম এ যুক্তি তুলে ধরলেও কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি।
৩৫ টাকার খাবার স্টার গ্রুপের সব রেস্তোঁরায় রয়েছে। কিন্তু ভ্যাট দেওয়া হয় না। এর মাধ্যমেও মাসে কয়েক লাখ টাকা ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
জয়কালী মন্দির এলাকায় স্টার হোটেল সুপার লিমিটেডে রেস্তোঁরা, আবাসিক হোটেল ও বেকারিতে অভিযানেও ভ্যাট ফাঁকির একই চিত্র দেখা গেছে।
অনলাইন ও ফোনে অভিযোগের ভিত্তিতে একযোগে অভিযান চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন এনবিআর সদস্য (মূসক নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা) মো. রেজাউল হাসান।
তিনি জানান, স্টার প্যালেস, স্টার কাবাব অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, ওয়ান স্টার হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন নামে স্টার গ্রুপের ১১টির বেশি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
মূসক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এলিফ্যান্ট রোডের স্টার হোটেল ও রেস্টুরেন্টের বেশ কিছু কাঁচা চালান ইস্যুর প্রমাণসহ হাতেনাতে ম্যানেজারকে ধরে ফেলেছেন।
ভ্যাট ফাঁকির বিরুদ্ধে সচেতন করতে এটা বড় ধরনের অভিযান জানিয়ে তিনি বলেন, ফাঁকির ভয়াবহ চিত্র পেয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক দলিলাদি জব্দ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, স্টার হোটেল ও কাবাবের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর কোটি কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার কারণে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান ভ্যাট প্রদানের ক্ষেত্রে উৎসাহিত হয় না।
এনবিআর থেকে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার লক্ষ্যে এবং ভ্যাট ফাঁকি রোধে এ ধরনের অভিযান পরিচালনার নির্দেশ রয়েছে।
মূসক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, স্টার’র বিরুদ্ধে অন্তত ২ শতাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এমনিতেই ভ্যাট দেয় না, তার ওপর পার্সেলে ভ্যাট বিষয়ে ভোক্তাকে নিরুৎসাহিত করে। আমাদের উদ্দেশ্য সচেতন করা, আমরা সফল হয়েছি।
গত ছয়মাসে অাগোরা, হাতিল, পারটেক্স, সিপি, ধানসিঁড়ি রেস্তোঁরা, হান্ডিবাজারসহ প্রায় ৭০টি ভ্যাট ফাঁকির অভিযান পরিচালনা করে ব্যাপক ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও জানান তিনি।
কর ফাঁকির অভিযোগে স্টার কাবাবসহ ১১ প্রতিষ্ঠানে অভিযান
বাংলাদেশ সময়: ১০১৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৬
আরইউ/এএসআর