ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা

বৈদেশিক সহায়তা নির্ভর মহাপরিকল্পনা

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩০ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৬
বৈদেশিক সহায়তা নির্ভর মহাপরিকল্পনা

ঢাকা: ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, বন্যা, আকস্মিক বন্যা, টর্নেডো, কালবৈশাখি ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতি বছর মোকাবেলা করতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনে বেড়ে যাওয়া এসব দুর্যোগ মোকাবেলায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ খাতে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার।

উপকূলীয় এলাকায় পূর্বাভাস দিয়ে সহায়তা ও কৃষি খাতে নতুন করে চারটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

এ চারটি প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক সহায়তা খাত হিসেবে ১ হাজার ৮৪৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা মূলত বৈদেশিক সহায়তা নির্ভর।

জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষা করে দেশের কৃষি উন্নয়ন, নদ-নদী রক্ষা ও আবহাওয়া অধিদফতর উন্নয়ন খাতে ছয় বছরে মহাপরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করা হবে। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় পৃথক পৃথকভাবে চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।

নব্বইয়ের দশকে প্রণীত ‘ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যানে (এনইএমএপি)’ দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগকে। কোনো দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সত্যিই পড়ছে কি-না, তা চারটি মানদণ্ডে বিবেচনা করা হয়। যার সকল মানদণ্ডই রয়েছে বাংলাদেশে।

আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচের ২০১০ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স (সিঅারআই) অনুসারে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্থ দেশের মধ্যে প্রথমেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ। ১৯৯০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১৯৩টি দেশের ওপর এ সমীক্ষা চালানো হয়। এ প্রতিষ্ঠানের ২০০৭ ও ২০০৮ সালের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্থতার বিচারে বিশ্বব্যাপী গবেষকরা বাংলাদেশকে ‘পোস্টার চাইল্ড’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিপূরণ চেয়ে বার বার বিশ্ব দরবারে সোচ্চার বাংলাদেশ। উন্নত দেশগুলো নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনে বেশি ভূমিকা পালন করছে। যার ফলে স্থলভাগে ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, কিংবা সাগরে নিম্নচাপ বাড়ছে।

এছাড়া পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাংলাদেশের স্বাভাবিক চিত্রটি এখন অনেকখানি বদলে গেছে। তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্রস্তর - সবদিকে সংঘটিত এসকল পরিবর্তন বাংলাদেশে স্পষ্ট লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এসব মোকাবেলায় মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে।

পৃথক পৃথকভাবে জলবায়ু মোকাবেলা ও কৃষিসহ নানা খাতে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় এ অর্থ খরচ করা হবে। চলতি বছরের শেষ সময় থেকে ২০২২ সাল নাগাদ টাকা খরচ করা হবে।

দেশের প্রায় ৭২০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলে সংঘটিত জলোচ্ছ্বাসের ফলে জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার শিকার হয়ে উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার লাখ লাখ জনগণের জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। যথাযথভাবে পূর্বাভাস ও সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে এ সকল প্রাকৃতিক দুরোগের ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব বলে মনে করে সরকার।

এজন্য দুর্যোগ পরবর্তী ও পূর্ববর্তী সময়ে আবহাওয়ার সঠিক তথ্য, পানি এবং জলবায়ু সংক্রান্ত সঠিক তথ্যাদিতে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। সে লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংক ‘বাংলাদেশ ওয়েদার অ্যান্ড ক্লাইমেট  সার্ভিস রিজিওনাল প্রজেক্ট’ শীর্ষক প্রকল্পটিতে ৮৮৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা দিতে সম্মত হয়েছে।

দৈনন্দিন পূর্বাভাস ও তথ্যাদি দেওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরকে আরও শক্তিশালী করা হবে। সে লক্ষ্যে ‘স্ট্রেনদেনিং মেট্রোলজিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিস অ্যান্ড ইয়ার্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম’ প্রকল্পের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আবহাওয়া অপারেশনাল কাযর্ক্রম নির্ভুল করা হবে। এতে মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৩০ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, যার অধিকাংশই আসবে বিশ্বব্যাংক থেকে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া ও জলবায়ু সেবা সংক্রান্ত আঞ্চলিক প্রকল্পটির মাধ্যমে আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্যসেবা, বৃষ্টিপাত সম্পর্কিত তথ্যসেবা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও আগাম সতকর্তা এবং কৃষিভিত্তিক আবহাওয়া বার্তার উন্নয়ন করা হবে। এটি একটি ৬ বছর মেয়াদী প্রকল্প। প্রকল্পটির উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলোর মধ্যে রয়েছে- আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও আগাম সতকর্তামূলক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, অতি আঞ্চলিক ঘটনাপ্রবাহের তথ্য সরাবরাহ বৃদ্ধি, হাইড্রো-ম্যাটিরলজিকাল (আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাত) সেবাপ্রাপ্তদের (সুবিধাভোগী) সংখ্যা বৃদ্ধি ও কৃষিভিত্তিক আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য পরিসেবার মাধ্যমে সুবিধাভোগী কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের মহাপরিচালক শামসুদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘জলবায়ু প্রতিনিয়তই পরিবর্তিত হচ্ছে। এতে করে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষসহ সার্বিক তথ্য ও আবহাওয়া অপারেশনাল কাযর্ক্রম নির্ভূল করা জরুরি। সে লক্ষ্যে ‘স্ট্রেনদেনিং মেট্রোলজিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিস অ্যান্ড ইয়ার্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম’ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি নিয়ে আমরা দেড় বছর কাজ করছি। প্রকল্পের আওতায় পরামর্শক নিয়োগসহ নানা ধরনের কাজ করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রকল্পের আওতায় বিশ্বব্যাংকের ঋণ পাওয়া গেছে। এ প্রকল্পে সরকারি অর্থায়ন যৎসামান্য’।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) পৃথিবীর অন্যান্য দেশের প্রযুক্তির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে পানি বিজ্ঞানের উন্নয়ন, বিভিন্ন স্থানে পানির পরিমাণ, বিদ্যমান স্টেশনগুলোকে অটোমেশন করে হাইড্রোজেন তথ্য সংগ্রহ করবে। এসব তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ ও নিশ্চিত করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ‘স্ট্রেনদেনিং হাইড্রোলজিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিস অ্যান্ড ইয়ার্লি ওয়ার্মিং সিস্টেমস’ প্রকল্পের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রকল্পে মোট ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৫৬ কোটি ৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক সহায়তা হিসেবে পাওয়া যাবে ৩১৯ কোটি ৩১ লাখ টাকা।

অন্যদিকে কৃষকদের কৃষি আবহাওয়া, নদ-নদী সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কিত তথ্যাদি দিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে কৃষি-আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি প্রচলনে সহায়তা জরুরি। কৃষি উৎপাদন টেকসই করার লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাধ্যমে ‘অ্যাগ্রো-মেট্রোলজিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেমস ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্পের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রকল্পে মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১২৫ কোটি ৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক সহায়তা হিসেবে ১০৬ কোটি টাকা পাওয়া যাবে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোশাররফ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, বৈজ্ঞানিকভাবে কৃষি-আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি প্রচলনে সহায়তা দিতে ‘অ্যাগ্রো-মেট্রোলজিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেমস ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তা হিসেবে ১০৬ কোটি টাকা পাওয়া যাবে। প্রকল্পটি এখন প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১২২৫ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৬
এমআইএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।