ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

গামছার গ্রাম পাঁচলিয়া

গামছার গ্রাম পাঁচলিয়া

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৪ ঘণ্টা, জুন ৭, ২০১৬
গামছার গ্রাম পাঁচলিয়া ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সিরাজগঞ্জ: তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে

গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।

অথবা

আমার বাড়ি যাইও ভোমর,
বসতে দেব পিঁড়ে,
জলপান যে করতে দেব
শালি ধানের চিঁড়ে।


শালি ধানের চিঁড়ে দেব,
বিন্নি ধানের খই,
বাড়ির গাছের কবরী কলা
গামছা বাঁধা দই।

বাঙালির অতি প্রয়োজনীয় এক টুকরো কাপড়ের নাম গামছা। আভিধানিক অর্থে গা মোছার জন্য যে এক টুকরো কাপড় ব্যবহার হয় সেটাই গামছা। তবে এর নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে আমাদের জীবনে। যার কিছুটা উঠে এসেছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’ ও পল্লীকবি জসিম উদ্দিনের ‘আমার বাড়ি’ কবিতায়।

দৈনন্দিন বাঙালি জীবনের অন্যতম অনুসঙ্গ এই কাপড়টি চৈত্র-বৈশাখের কাঠ ফাটা রোদ আর প্রচণ্ড উত্তাপে ঘর্মাক্ত ক্লান্ত পথিককে শান্তির ছোঁয়া দিয়ে যায়। রোদেলা দুপুরে ফসলের মাঠে কঠোর পরিশ্রমে ক্লান্ত কৃষক গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেন কাঁধের গামছাখানা পেতেই। এভাবে গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষা, শরৎ কিংবা শীত সব ঋতুতেই গামছা ব্যবহার করে বাঙালি।

যদিও কালের বিবর্তনে অনেকে গামছার পরিবর্তে তোয়ালে ও রুমাল ব্যবহার করলেও গামছার চাহিদা এতোটুকুও কমেনি।

এই গামছা উৎপাদন করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার পাঁচলিয়া গ্রামের কয়েক হাজার তাঁতি।

তাঁতের খটখট কিংবা পাওয়ারলুমের মোটরের শব্দে সারা বছরই মুখরিত থাকে গামছার গ্রাম খ্যাত পাঁচলিয়া গ্রামটি। কয়েক হাজার নারী-পুরুষ শ্রম দিচ্ছে এ শিল্পে।

কথিত রয়েছে দেশে সর্বপ্রথম গামছা উৎপাদন শুরু হয় পাঁচলিয়া থেকেই। তবে এখন বেলকুচি, শাহজাদপুর, রায়গঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বেশকিছু গ্রামে গামছার কারখানা রয়েছে।

পাঁচলিয়া গ্রাম ঘুরে শ্রমিক, মালিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ছোট-বড় প্রায় দেড় হাজার কারখানায় অন্তত আড়াই হাজার তাঁত রয়েছে। যাতে কাজ করছেন প্রায় ১০ হাজার নারী-পুরুষ।

সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আলোকদিয়া, হোড়গাঁতী, নলকা, এরান্দহ, রতনকান্দি, সাহেবগঞ্জ, বানিয়াগাঁতী, আমডাঙ্গা, উলিপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে দলে দলে শ্রমিকরা আসেন গামছার গ্রাম পাঁচলিয়ায়।

সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন তারা। নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে তৈরি করে যান হাজার হাজার পিস গামছা। এভাবেই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে পাঁচলিয়া গ্রামের চালচিত্র।

গ্রামের ৭৫ বছরের আব্দুর রশিদ প্রামাণিক জানালেন গামছা উৎপাদনে পাঁচলিয়া গ্রামের কারিগরদের ভূমিকার কথা।

তিনি বলেন, বৃটিশ আমলে এ গাঁয়ের তাঁতি সম্প্রদায়ের মানুষ গামছা উৎপাদন শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও এ পেশায় আসেন। উত্তরাঞ্চল থেকে শুরু করে সমগ্র ভারতবর্ষে এ গামছা রপ্তানি হতো। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর পাঁচলিয়া-সিরাজগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের পাশে স্কুলমাঠে গামছা, সুতা ও রঙের হাট বসানো হয়। ধীরে ধীরে এ হাটটি গামছার হাট নামে পরিচিতি পায়।

নুরুল ইসলাম আকন্দ নামে অপর এক বৃদ্ধ বলেন, নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে গামছাকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে আছে পাঁচলিয়া গ্রামের তাঁতিরা।  

উল্লাপাড়ার বালশাবাড়ী থেকে পাঁচলিয়ায় তাঁতের কাজ করতে আসা শ্রমিক আব্দুল কাদের, আলোকদিয়ার এলাকার নুরনবী সরকার, পাঁচলিয়ার জহুরুল, মুকুল হোসেন, সুমন. শামীম হোসেন, আব্দুল লতিফ, আবু শামা,  মনিরুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন শ্রমিক জানান, সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কাজ করে আড়াই থেকে তিন থান গামছা বুনানো যায়। প্রতি থান গামছা তৈরি করে মজুরি ১০০ থেকে ১২০ টাকা করে পান। এতে সপ্তাহে একেকজন শ্রমিক দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন।

নারী শ্রমিক মনিজা খাতুন, জহুরা খাতুন ও বিলকিস বেগম জানান, তারা সংসারের অন্যান্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাঁতের কাজ করেন। কেউ কেউ সুতা জোড়েন, কেউ বা আবার গামছা বোনেন। এতে তারা সপ্তাহে হাজার /১২শ’ টাকা আয় করে স্বামীকে সহায়তা করেন।

পাঁচলিয়া গ্রামের তাঁত মালিক শফিকুল ইসলাম, আলমাছ আলী, দুলাল উদ্দিন ও নুর ইসলামসহ বেশ কয়েকজন তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানকার বেশিরভাগ তাঁতিই নিম্ন মধ্যবিত্ত। একেকজন তাঁতির তিন থেকে সর্বোচ্চ ২৫টি তাঁত কারখানা রয়েছে।

তাঁত ব্যবসায়ীরা আরো জানান, কারখানা থেকে উৎপাদিত গামছা প্রতি শুক্রবার ও মঙ্গলবার পাঁচলিয়া গামছার হাটে তোলা হয়। ঢাকার গাউছিয়া, কাজিরহাট, নরসিংদীর বাবুরহাট, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, এনায়েতপুর, পাবনার আতাইকুলা, পঞ্চগড়ের আটোয়ারীসহ দেশের বড় বড় কাপড়ের হাটের ব্যবসায়ীরা এখান থেকে গামছা কিনে নিয়ে যান।

পাইকোশার ক্ষুদ্র তাঁত কারখানার মালিক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বর্তমানে গামছার তাঁতিদের আয় খুবই কমে গেছে। এক থান গামছায় সুতা, রং ও শ্রমিকের মজুরি দিয়ে প্রায় ১৬০ টাকা থেকে ১৮০ টাকা খরচ পড়ে। আর প্রতি থান বিক্রি হয় ১৭০ থেকে ১৯০ টাকা। খুব ভালো বাজার থাকলে প্রতি থানে ১০ টাকা লাভ হয়। বাজার খারাপ হলে তাঁতিদের মূলধন ফিরে পাওয়াই কঠিন হয়। এতে যাদের দুই থেকে তিনটি তাঁত রয়েছে, তাদের মাসে পাঁচ হাজার টাকা আয় করাই কঠিন হয়ে পড়ে।

পাঁচলিয়ার তাঁত মালিক গোলাম হোসেন ও শহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, এক সময় গামছা উৎপাদনকারীরা ভালো ব্যবসা করতে পারলেও বর্তমানে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে আমাদের। শাড়ি ও লুঙ্গির বাজার মন্দা হওয়ায় বড় বড় তাঁত ব্যবসায়ীরাও এখন গামছার দিকে ঝুঁকে পড়ায় হাটে গামছার আমদানি বেড়েই চলেছে। এতে ক্ষুদ্র তাঁত মালিকরা পড়ছেন বিপাকে। অনেক ক্ষুদ্র তাঁতি বাধ্য হয়ে তাদের তাঁত বন্ধ করে দিচ্ছেন। সরবরাহ অনেক বেশি হওয়ায় পাইকাররা দাম দিতে চান না।

আগে তাঁতবোর্ড থেকে ১০ থেকে ১৩ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হতো। যা ছিল খুবই নগন্য। বর্তমানে সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে মুখ থুবড়ে পড়ছে পাঁচলিয়ার গামছা শিল্প। গামছা শিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দেওয়ার দাবি জানান তাঁতিরা।

পাঁচলিয়া গামছার হাটে আসা ব্যবসায়ী সিরাজগঞ্জের কামারখন্দের জুয়েল হোসেন, সুমন, আবুল হাসেম, আব্দুল খালেক ও আব্দুস সালাম জানান, তারা প্রতি হাটে চার/পাঁচ হাজার পিস গামছা কিনে গোডাউনে রাখেন। গোডাউন থেকে সারাদেশে গামছাগুলো সরবরাহ করা হয়।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা বলেন, পাইকোশা এলাকার মহাজনদের কাছ থেকে হাজার হাজার পিস গামছা নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা।

নরসিংদীর বাবুরহাটের গামছা ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন জানান, সারাদেশে পাঁচলিয়ার গামছার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড সূত্রে জানা যায়, দেশের মধ্যে পাঁচিলিয়া গ্রামেই সর্বাধিক সংখ্যক গামছা তৈরি হয়। এ গ্রামে প্রায় সাড়ে ৮শ’ তাঁতি পরিবার রয়েছে।

সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির সদস্য নব কুমার কর্মকার বাংলানিউজকে বলেন, গামছা সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্য। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এ শিল্পটির এখন করুন দশা।

ক্ষুদ্র তাঁত মালিকদের সুদ মুক্ত ঋণ, তাঁত শ্রমিকদের ৪০ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি ও বিদেশি বস্ত্র আমদানি বন্ধ করে তাঁত শিল্প রক্ষার দাবি জানান তিনি।

বাংলাদেশ তাঁতবোর্ড উল্লাপাড়া ও রায়গঞ্জ অঞ্চলের লিয়াজো অফিসার আব্দুল খালেক বাংলানিউজকে বলেন, সমিতির মাধ্যমে মাসিক কিস্তিতে তাঁতিদের ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়া হয়ে থাকে। পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় স্বল্প সংখ্যক তাঁতি এ ঋণ সুবিধা পেয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, উল্লাপাড়া ও রায়গঞ্জ উপজেলায় ১২ হাজার ৩৬৪ জন তাঁতির মধ্যে ঋণ সুবিধা পেয়েছেন মাত্র ৯৭৬ জন। সঠিকভাবে ঋণ আদায় না করতে পারায় বর্তমানে ঋণ দেওয়া কমে গেছে।

উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সন্দ্বীপ কুমার সরকার বাংলানিউজকে বলেন, গামছা শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে যা কিছু করণীয় তা আমরা করতে চাই। প্রশিক্ষণ কিংবা ক্ষুদ্রঋণ যে ধরনের সহযোগিতাই প্রয়োজন হোক না কেন সরকারিভাবে তা করা হবে।

এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে তাঁতিদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান ইউএনও।

বাংলাদেশ সময়: ০৭০০ ঘণ্টা, জুন ০৭, ২০১৬
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।