ঢাকা: হারানো মসলিন শাড়ির কদর ছিল পুরো বিশ্বজুড়ে। সোনালি মসলিনের এ ঐতিহ্য একমাত্র ফুটি (Phuti) কার্পাস গাছের তুলা ব্যবহার করে ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড।
বিশেষ করে রাজশাহী, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী এবং পাহাড়ি এলাকায় ফুটি কার্পাস গাছের অনুসন্ধানে ‘সোনালী ঐতিহ্য মসলিনের সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার’ প্রকল্প হাতে নিয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সরকারি সংস্থাটি। ১২ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির আওতায় মসলিন শাড়ি ও কাপড়ের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে দেশি-বিদেশি প্রযুক্তি উদ্ভাবনেও নানা গবেষণা করা হবে। ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।
সপ্তদশ শতকে মসলিন শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায়। তবে এর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে মোঘল আমলে।
দিয়াশলাইয়ের বাক্সে একটি মসলিন শাড়ি অনায়াসে পুরে ফেলা যেতো। এর পাশাপাশি সাধারণ আংটির মধ্য দিয়ে প্রবেশ করানো যেতো প্রায় ৪০ হাত লম্বা আর দুই হাত চওড়া কাপড়ের একটি পুরো টুকরো। ওই সময়ে মসলিন তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল ঢাকা, সোনারগাঁও, ধামরাই, টিটবাদি, বাজিতপুর ও জঙ্গলবাড়ি।
ঐতিহ্যবাহী মসলিন কাপড় ফুটি কার্পাস থেকে তৈরি হয়েছিল বলে মনে করে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়। উন্নতমানের কার্পাস জন্মাতো বাজিতপুরে। হাজার বছরের হারানো মসলিন শাড়ির ঐতিহ্য ফেরাতে তাই ওইসব অঞ্চলসহ সারা দেশে ফুটি কার্পাস গাছের তুলা খুঁজবে তাঁত বোর্ড। পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে মসলিনের স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালানো হবে।
তাঁত বোর্ড সূত্র জানায়, ফুটি কার্পাস গাছ পাওয়া গেলে এর বীজ সংগ্রহ করা হবে। যদি ফুটি কার্পাস না পাওয়া যায় তবে প্রাচীন আমলে যেসব দেশে মসলিন কাপড় রফতানি করা হতো, বিশেষ করে ইংল্যান্ড, জাপান, ভারত, পাকিস্তান ও উজবেকস্তান থেকে মসলিন কাপড়ের জার্মকিট সংগ্রহ করা হবে। এ জার্মকিট থেকেও ফুটি কার্পাস গাছ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের সদস্য (পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন) নিমাই চন্দ্র পাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা যেকোনো মূল্যে মসলিনের হারানো ঐতিহ্য ফেরাতে চাই। তবে তার আগে আমাদের খোঁজ করতে হবে ফুটি কার্পাস। কারণ, প্রাচীনকালে এর তুলা থেকেই তৈরি হতো মসলিন কাপড়। এ গাছ পাওয়ার পর আমরা ব্যাপকভাবে গবেষণা চালাবো। কারণ, ফুটি কার্পাস পেলেই মসলিন কাপড় বুননের সুতা তৈরি করতে পারবো না। এখন জলবায়ুর অনেক পরিবর্তন হয়েছে’।
‘যদি ফুটিকার্পাস না পাই, তবে আমরা যেসব দেশে মসলিন কাপড় রফতানি করেছিলাম, সেসব দেশ থেকে জার্মকিট সংগ্রহ করবো। পরিবেশ ও জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাওয়াতেও আমরা নানা গবেষণা পরিচালনা করবো’।
বোর্ড সূত্র জানায়, প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকল্পের আওতায় স্পিনিংকরণের জন্য শেড ভাড়া ও দক্ষ স্পিনারের সাহায্যে মসলিন সুতা বুননের উন্নতমানের শেড নির্মাণ করা হবে।
পরে স্থানীয় পরামর্শক ও গবেষকের পাশাপাশি বিদেশি একজন সিনিয়র বায়োটেকনোলজিস্ট নিয়োগ করা হবে। মসলিন তৈরির গবেষণা কার্যক্রমে নমুনা সংগ্রহ, নমুনা থেকে মসলিন সুতার ডিএনএ প্রোফাইল শনাক্তকরণ এবং মসলিন তৈরির উপযোগী তুলা গাছের অনুসন্ধান করা হবে। সমজাতীয় তুলা জাতেরও উন্নয়ন, পরীক্ষামূলকভাবে তুলার চাষাবাদ ও তুলা সংগ্রহ করা হবে। সংগৃহীত তুলা স্পিনিং করে মসলিন তৈরির উপযোগী কাউন্টের সুতা উৎপাদনের পর পরীক্ষামূলকভাবে মসলিন কাপড় বুনন করা হবে।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের সঙ্গে এ প্রকল্পে সহায়তা করবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্স, বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইউনিভার্সিটি এবং বস্ত্র পরিদফতর।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের পরিচালক ও বায়োটকনোলজিক্যাল বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. মনজুর হোসেনের নেতৃত্বে সার্বিক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। তার টিমের অন্য দুই সদস্য হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. এম ফিরোজ আলম ও অ্যাগ্রোনমি অ্যান্ড অ্যাগ্রিল এক্সটেনশন বিভাগের প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
গবেষক টিমের সদস্যদের সম্মানি, দক্ষ বুননকারী ও স্পিনারের মজুরিও প্রকল্পের আওতায় দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৬
এমআইএস/এএসআর