নতুন বছর ২০১৭ সালের আগমনের প্রাক্কালে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাংলানিউজকে এক একান্ত সাক্ষাৎকার দেন তিনি।
বাংলানিউজ: ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিযোগের ক্ষেত্রে ২০১৬ টা কেমন গেল।
আব্দুল মাতলুব আহমাদ: বাংলাদেশ পৃথিবীকে আশ্চর্য করে দিয়ে ২০১৬ তে একটি তেজী উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ২০১৬ তে বাংলাদেশের এ গতি গোটা পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছে। সারা পৃথিবীর বড় বড় শিল্পপতিরা বাংলাদেশ ভিজিটে এসেছেন। আলাপ-আলোচনা করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরও করেছেন।
এ চলার পথে দুটো আঘাত আমরা সহ্য করেছি। একটা হল জুলাই মাসে হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসীদের আক্রমণ আর একটি বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরি।
আমরা যদি হলি আর্টিজানের ঘটনা দেখি, প্রধানমন্ত্র্রী শেখ হাসিনা তড়িৎ গতিতে এবং সর্বশক্তি দিয়ে এ ঘটনাকে মোকাবিলা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের মোকাবিলা সারা পৃথিবীতে প্রশংসিত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তারপর থেকে প্রধানমন্ত্রী ধারাবহিকভাবে জঙ্গিবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। দেশে কোনো জঙ্গিবাদ থাকবে না। এজন্য যত কার্যক্রম প্রয়োজন তিনি গ্রহণ করে চলেছেন।
বাংলানিউজ: সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপে ব্যবসায়ী তথা বিদেশিরা কী সন্তুষ্ঠ?
আব্দুল মাতলুব আহমাদ: জঙ্গিদের কোনো প্রকার চিহ্ন দেখা গেলেই সঙ্গে সঙ্গে তা মোকাবিলা করার জন্য সরকার ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তার সুফলও আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি।
জঙ্গিবাদের উত্থান প্রধানমন্ত্রী হতে দেবেন না। তাই তিনি পুরো গর্ভমেন্ট মেশিনারিকে প্রস্তুত করেছেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, অতি তাড়াতাড়ি তিনি হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার আঘাত তিনি সামলে উঠেছেন। এ ঘটনার পরও আমরা একটার পর একটা বিদেশি ডেলিগেশন পাচ্ছি। শেষ আমরা জাপান থেকে ঘোষণা পেলাম তারাও এখন নিশ্চিত যে, বাংলাদেশ শুধু বিনিয়োগের জন্য নয়, বসবাসের জন্যও নিরাপদ।
বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশিদের আতঙ্ক কেটে গেছে। যারা তাদের কাজ বন্ধ করে চলে গিয়েছিলেন তারা সকলেই ফিরে আসছেন। চীন, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশের লোকেরাই ফিরে আসছেন। আমরা হলি আর্টিজানের ঘটনা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাই না। এ ঘটনা এখন অতীত হয়ে গেছে। কিন্তু বলে রাখা ভালো সরকার কিন্তু এটা ভোলেনি। সরকার কিন্তু শতকরা একশ ভাগ অ্যালার্ট জঙ্গি দমনে। সব রকমের প্রস্তুতি সব সময়ে রাখছে সরকার। সারাক্ষণই সরকার তৎপর যাতে জঙ্গিদের উত্থান আর না হয়। এটা শুধু করছে না জানানও দিচ্ছে। সরকার প্রতিনিয়ত এ বিষয়ে সব বিদেশি দূতাবাসে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। জানানো হচ্ছে, আমরা কখন কি কি করছি। এর ফলে বিশ্বাসের পারদ এখন বাংলাদেশে যতোটা উপরে আছে অতীতের কোনো সময় তা এরকম ছিল না। অতীতে মানুষ একটু ভয় পেত। কিন্তু এখন জানে, সরকার সজাগ আছে, সরকার কার্যকর সরকার তৎপর। সেজন্য ভয়ের কোনো কারণ নেই।
বাংলানিউজ: ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য কানেটিভিটির কী অবস্থা, আপনি নিজে কি এ সম্পর্কিত বাণিজ্য ও কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত আছেন?
আব্দুল মাতলুব আহমাদ: বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে সম্পর্ক তা ১৯৭৪ সালে যে লেবেলে ছিল আমরা মোটামুটি সে লেবেল বা তার চেয়ে বেশি উচ্চতায় চলে এসেছি। ক্রমশই দেখবেন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটার পর একটা চুক্তি হচ্ছে এবং আমরা সম্পর্কের উন্নয়ন করে চলেছি। কিছুদিনের মধ্যেই খুলনার সঙ্গে কলকাতার রেল যোগাযোগ চালু হবে। স্বাধীনতার আগে ভারতের সঙ্গে যতগুলো জায়গা দিয়ে আমাদের আগের চালু যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সেগুলো আমরা নতুন করে চালু করছি। শুধু তাই নয়, কানেকটিভিটি এখন আগের চেয়ে আরো মসৃণ করা হচ্ছে।
বিবিআইএম রোড নিয়ে চুক্তি হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশ, ভুটান ভারত ও নেপাল এ সংক্রান্ত নানা বিষয়ে এরই মধ্যে সম্মত হয়েছে। আর কিছুদিনের মধ্যে এসব দেশের সঙ্গে পুরোদমে যোগযোগ চালু হয়ে যাবে।
বাংলানিউজ: বাংলাবন্ধাসহ ভারতের দিকের সীমান্ত বন্দরগুলোর অবকাঠামো এখনও মসৃণ হচ্ছে না কেন?
আব্দুল মাতলুব আহমাদ: আপনাকে মনে রাখতে হবে ভারত একটা বিশাল দেশ। অনেক দেশের সঙ্গে তার সীমান্ত রয়েছে। বেশকিছু সীমান্তে দেশটির সমস্যাও আছে। ভারতের যে বাজেট হয় তাতে বাংলাদেশের সীমান্তে বিনিয়োগ করার জন্য বহু অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনেক জায়গায় উন্নয়ন হয়েছে। এখানে বাংলাদেশ বা ভারতের পক্ষ থেকে সদিচ্ছার অভাব কোথাও নেই। একটা দেশের বাজেট উপস্থাপন করতে সময় লাগে। সে বাজেটের অর্থ নির্দিঁষ্ট এলাকায় পৌঁছাতে সময় লাগে। ভারতে সিস্টেমটাই হলো, কেন্দ্রে ও রাজ্য শাসিত। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়েও ভালো উন্নয়ন হয়েছে। তারপরেও বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের আরো কাজ করতে হবে।
বাংলানিউজ: ভারতের চ্যানেলগুলোতে বিভিন্ন বাংলাদেশি কোম্পানি বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। সে কারণে বাংলাদেশে আন্দোলন প্রতিবাদ হচ্ছে। এটিকে কীভাবে দেখছেন?
আব্দুল মাতলুব আহমাদ: দেখুন এ বিষয়ে আমাদের দেশে প্রতিবাদ হয়েছে। আপনি যদি অবৈধ পথে এ টাকা নিয়ে যান তবে তা অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, সারা পৃথিবী এখন গ্লোবাল বিজনেস এরেনা। এখন আর কোনো অর্থনৈতিক বর্ডার নেই। ভারতসহ বিশ্বের যে কোনও দেশ যদি তার বা তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন দিতে চায় অবশ্যই তারা তা করতে পারে। এজন্য কোনও বাধা নাই। খালি খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের দেশে অনেক টিভি চ্যানেল হয়েছে, মিডিয়া, অনলাইন, সংবাদপত্র হয়েছে এদেরকেও সারভাইবাল পজিশনে রাখার জন্য তাদের বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রে, বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতি সুদৃষ্টি রাখতে হবে। আমার অনুরোধ থাকবে যাদের বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রচুর সামর্থ্য আছে তারা যেন বাইরে দু-চারটা বা পাঁচটা অ্যাড কমিয়ে বাংলাদেশে দেবার ব্যবস্থা করেন। তাহলে দেশ ও দেশের মানুষ উপকৃত হবে। বাংলাদেশের মিডিয়া খুব ব্যবসাবান্ধব। এখানে বিজ্ঞাপন দিলে রির্টান ভালো পাওয়া যায়। সে হিসাবে তাদের স্বার্থে বাংলাদেশে আরো বিজ্ঞাপন দেওয়া উচিত।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশ এখনই কি বিদেশে বিনিয়োগ করার সামর্থ্য অর্জন করেছে?
আব্দুল মাতলুব আহমাদ: আমি ফ্রি ট্রেডে বিশ্বাসী। আমি গ্লোবাল বিজনেসে বিশ্বাসী। আমাদের যে কারেন্সি ব্লকড হয়ে আছে এটাকে রিমুভ করে একাউন্ট খুলে দেওয়ার রপক্ষে আমি। আমাদের পৃথিবীকে একটা মার্কেট হিসেবে ধরে নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে বর্ডারলেস ইকোনমির নীতিতে এগিয়ে যেতে হবে। সংকীর্ণমনা অবস্থান থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। আজকে যদি আপনি আপনার ব্যবসা ভালো না করেন, এর সীমা না বাড়ান তখন আমি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকা পড়ে যাবেন। এর জন্য দেশ বা অন্য কোনো কোম্পানিকে দোষারোপ করাটা আমাদের জন্য হবে ক্ষতিকর।
বাংলানিউজ: বিদেশে জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ ও বিদেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান এখন কী অবস্থায় আছে?
আব্দুল মাতলুব আহমাদ: বিদেশে জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ ও বিদেশে বিনিয়োগ করার জন্য অনেকে জমি দেখছে। আমি জানি তারা অনুমতিও পাবে। কিছুদিন আছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-র মিটিং হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে। সেখানে এ প্রশ্ন উঠেছিল। যেহেতু বাংলাদেশের এখন ৩২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ, তাই এ বিষয়ে সরকার আমাদের পজেটিভ সিগন্যাল দিয়ে দিয়েছে। এখন যদি বলি, আমরা অমুক দেশে ১০ টাকা খাটিয়ে ৫ বছরে ২০/৩০ টাকা নিয়ে আসতে পারব সেটা যদি আমরা বিডাকে লিখি তাহলে বিদেশে বিনিয়োগ করার জন্য সরকারই আমাদের ফান্ড দেবে। এটা প্রধানমন্ত্রীর লেবেল থেকেই বলা হয়েছে। এখন বাংলাদেশের মানুষের উচিৎ হবে ফলো দ্য সিস্টেম।
তলা দিয়ে নিয়ে গিয়ে যে-সে ব্যবসা করে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদেরকে লিগ্যাল সিস্টেমে যেতে হবে এবং এ লিগ্যাল সিস্টেমটা অতি তাড়াতাড়ি একেবারেই ওপেন হবার সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী কনভিন্সড। বিডা ইজ কনভিন্সড। শুধু দেশে নয়--বাংলাদেশ আজ ৪৫ বছর হলো স্বাধীন হয়েছে--এখন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা অনেক অভিজ্ঞ। তারা পৃথিবীতে বহু জায়গায় ব্যবসা করে বাংলাদেশকে আরো সমৃদ্ধ করতে পারবেন বৈদেশিক মূদ্রা আনার মাধ্যমে। এটা সরকার বুঝতে পেরেছে। এখন আমাদের শক্তিটা আমরা ব্যবহার করব দেশে এবং বিদেশে। মনে রাখতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশের লিডার নন, তিনি এখন গ্লোবাল লিডার। গ্লোবাল এরেনায় ওনার চলাফেরা। আমরাও যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করি, বাংলাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আমাদের ঘাঁটি গাড়ার সময় চলে এসেছে। এজন্য সরকার অতি তাড়াতাড়ি ক্যাপিটাল একাউন্ট খুলে দেবে বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৩, ২০১৭
কেজেড/জেএম