ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

মোবাইল ব্যাংকিং

লেনদেন সীমা কমার সিদ্ধান্তে চিন্তিত ব্যবসায়ীরা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৭
লেনদেন সীমা কমার সিদ্ধান্তে চিন্তিত ব্যবসায়ীরা

ঢাকা: ময়ময়সিংহের ত্রিশালের ক্ষুদ্র মাছ চাষি সোহাগ আলম মোবাইল ব্যাংকিং-এ লেনদেনে ঊর্ধ্ব-সীমার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা কথা শুনেছেন। নতুন সীমা কার্যকর হলে তার জন্য ব্যবসা পরিচালনা করা অনেক কঠিন হবে বলে মনে করেন তিনি।

কেননা তার ব্যবসা সংক্রান্ত আর্থিক লেনদেনের একটা বড় অংশই মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে করতে হয়।

এ প্রতিবেদকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয় সোহাগের।

তিনি বলেন, মাছের খাদ্যসহ অন্যান্য উপকরণ কেনার জন্য এখন আর বাজারে যেতে হয়না। মোবাইল ফোনে পাইকারকে অর্ডার দিয়ে দেন এবং মাল বুঝে পাওয়ার পর মূল্য পরিশোধ করেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। অন্যদিকে উৎপাদিত মাছ ট্রাকে করে পাঠিয়ে দেন ঢাকার কারওয়ান বাজারে একজন নির্দিষ্ট মাছ ব্যবসায়ীর কাছে এবং মূল্য বুঝে নেন সেই মোবাইল ব্যাংকিং-এ।

কিছু অসাধু ব্যক্তি মোবাইল ব্যাংকিং সেবার অপব্যবহার করছে এ মর্মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১১ জানুয়ারি (বুধবার) মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সীমা কমিয়ে দেয়াসহ বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে।

নতুন নির্দেশনা অনুসারে একজন গ্রাহক তার মোবাইল একাউন্টে দিনে দুইবারে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা ক্যাশ ইন করতে পারবেন এবং দিনে তিন বার সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা ক্যাশ-আউট করতে পারবেন। আগে একজন গ্রাহক দিনে ৫ বার ক্যাশ ইন এবং তিন বার ক্যাশআউট করতে পারতেন এবং উভয়ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সীমা ছিল ২৫ হাজার টাকা।

নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী একজন গ্রাহক তার মোবাইল একাউন্টে মাসে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত ক্যাশ ইন করতে পারবেন। যা আগে ছিল দেড় লাখ টাকা। একইভাবে একজন গ্রাহক মাসে সর্বোচ্চ ১০ বারে ৫০ হাজার টাকা ক্যাশ আউট করতে পারবেন, আগে যার পরিমাণ ছিল দেড় লাখ টাকা।
 
সোহাগ বলেন, নতুন নির্দেশনা কার্যকর হলে এখন অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। পাইকারকে পাওনা পরিশোধ করতে বা মাছ বিক্রির টাকা বুঝে পেতে বাজারে যেতে হবে। এতে সময় অপচয় হবে এবং খরচ বেড়ে যাবে।

একই ধরনের কথা বললেন, আইরিন কান্তা। যিনি রামপুরা এলাকায় একটি ক্ষুদ্র বুটিক শপ চালান। তিনিও মনে করেন, নতুন নিয়ম কার্যকর হলে কাঁচামাল সরবরাহকারীদের পাওনা পরিশোধ এবং শ্রমিকদের বেতন দিতে সমস্যায় পড়বেন।
‘সহজ, নিরাপদ এবং সুবিধাজনক হওয়ায় আমার আর্থিক লেনদেনের একটা বড় অংশই সম্পন্ন হ্য় মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে। কিন্তু ক্যাশ-ইন এবং ক্যাশ আউটের সর্বোচ্চ সীমা কমিয়ে ফেলার কারণে আমাকে এখন বাধ্য হয়ে মোবাইল ব্যাংকিং-এ কম লেনদেন করতে হবে। এখন অনেক ক্ষেত্রেই আমাকে নিজে যেয়ে পাওনা পরিশোধ করতে হবে বা ব্যাংকে যেতে হবে। এতে আমার খরচ বেড়ে যাবে। যা আমার মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর জন্য কষ্টের।

তিনি আরও বলেন, বুটিক শপ একাই পরিচালনা করি। ফলে এখন দোকান বন্ধ রেখে পাওনা পরিশোধ করতে যেতে হবে।

গাজীপুরের একটি নামী পোশাক কারখানায় সুপারভাইজরের কাজ করেন আকলিমা খাতুন। ওভারটাইম মিলে বেতন পান ২০ হাজার। কারখানাতে বেতন দেওয়া হয় মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে। বেতন পেলেই কিছু টাকা একাউন্টে রেখে ১৫ হাজার মতো টাকা ক্যাশ-আউট করে নিতেন বাসা ভাড়া, বাসার পাশের দোকান থেকে সারা মাস ধরে বাকিতে কেনা জিনিসের মূল্য পরিশোধ করতে, ছেলের ইস্কুলের বেতন দিতে এবং টুক টাক কিছু গৃহস্থালি ও শখের জিনিস কিনতে।  

নুতন নির্দেশনা অনুসারে একজন গ্রাহক ক্যাশ ইন করার ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৫ হাজার টাকার বেশি উত্তোলন করতে পারবেন না এবং ৫ হাজার টাকা বা তদোর্ধ্ব ক্যাশ আউট করার ক্ষেত্রে অবশ্যই এজেন্টকে জাতীয় পরিচয়পত্রের মূল বা ফটোকপি প্রদর্শন করতে হবে।

আকলিমা জানান, নতুন নিয়ম কার্যকর হলে ৫ হাজারের বেশি টাকা ক্যাশ আউট করতে পারবেন না, ফলে তাকে ক্যাশআউট করতে এজেন্টের কাছে যেতে হবে একাধিকবার। এতে জটিলতা বাড়বে বই কমবেনা।

আকলিমা  বলেন, বাড়িওয়ালা, দোকানদার সবাই বসে থাকে পাওনার জন্য কবে বেতন পাই। তাই তারা কোনো আজুহাতেই দেরি মানতে চায়না।

মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনের ঊর্ধ্ব-সীমার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নুতন নির্দেশনা কার্যকর হলে গ্রাহকদের সেবাটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পাশাপাশি সেবা ব্যবহারে আগ্রহ কমে যাবে বলেন মনে করছেন মোবাইল ব্যাংকিং গ্রাহক, এজেন্ট এবং খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস চালু হওয়ার কারনে ফলে ই-কমার্স সহ নানা ধরনের ব্যবসা বেড়েছে। অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেমন মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে তাদের ব্যবসায়ীক লেনদেন সম্পন্ন করছে, তেমনি অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান তাদের সরবরাহকারীদের পাওনা পরিশোধ থেকে শুরু করে কর্মীদের বেতনও দিচ্ছে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করে। ফলে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসকে কেন্দ্র করে এক ধরনের অর্থনৈতিক ইকো-সিস্টেম গড়ে উঠেছে। তাই এ খাতের বিকাশের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বাধা তৈরি হলে তা এই ইকো-সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নুতন নীতিমালা কার্যকর হলে এজেন্টদের আয়ও কমে যাবে বলে মনে করেন রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকার একজন বিকাশ এজেন্ট মান্নান ইসলাম।

‘আমরা মূলত গ্রাহকদের ক্যাশ ইন ও ক্যাশ আউটের পরিমাণের উপর কমিশন পাই। অর্থাৎ একজন গ্রাহক যতো বেশি ক্যাশ ইন এবং ক্যাশ আউট করবেন আমাদের কমিশনের পরিমাণ তত বেশি হবে। কিন্তু নতুন নীতিমালায় দৈনিক এবং মাসিক ভিত্তিতে ক্যাশ ইন এবং ক্যাশ আউটের সর্বোচ্চ সীমা কমিয়ে দেওয়ার ফলে আমাদের আয় কমে যাবে। ’

এ খাতে কর্মরত ব্যক্তিরা বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং সেবার অপব্যাবহার রুখতে ৫ হাজারের বেশি টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে গ্রাহকের জাতীয় পরিচয়পত্র বা তার ফটোকপি প্রদর্শনের যে বিধান করা হয়েছে তা কোনো কার্যকর সমাধান নয়। এটা বিষয়টিকে আরও জটিল করবে এবং গ্রাহকদের হয়রানি বাড়াবে।

এছাড়া এজেন্টদের পক্ষে কোনো ভাবেই কেউ ভুয়া আইডি ব্যবহার করে টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে কিনা তা শনাক্ত করা সম্ভব হবেনা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব মতে বাংলাদেশে নিবন্ধিত মোবাইল ব্যাংকিং গ্রাহক সংখ্যা তিন কোটি ৯৬ লাখ।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৭
এসই/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।