ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

‘অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নে বড় বাধা পরিচালন খরচ’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৭
‘অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নে বড় বাধা পরিচালন খরচ’

ঢাকা: বড় অংকের ঋণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যতো সংখ্যক কর্মকর্তা দরকার, ঠিক একইভাবে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণেও ততো সংখ্যক কর্মকর্তার প্রয়োজন হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনায় অনাগ্রহী। একারণে দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন (ইনক্লুসিভ ফিন্যান্সিং) হচ্ছে না। মানে, সব মানুষের কাছে অর্থায়নের সুফল পৌঁছাচ্ছে না। বাড়তি কর্মকর্তা নিয়োগের খরচ এড়াতে তাই  হালফিল মোবাইল প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো যেতে পারে। অর্থাৎ মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা ও মনিটরিং করা সম্ভব।
 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বাংলানিউজকে দেয়া এক  এক একান্ত সাক্ষাৎকারে এমন অভিমত ও পরামর্শ দেন।
 
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, অর্থনীতিতে আমরা উন্নতি করেছি।

৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন কম কথা নয়। তবে এই প্রবৃদ্ধির সুফল কি গুটিকয় ধনকুবের বা উচ্চবিত্তের হাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে, নাকি সমাজের দরিদ্রতম মানুষটি পর্যন্ত পৌঁছেছে? এটাই হচ্ছে বড় প্রশ্ন। সবার কাছে যদি প্রবৃদ্ধির সুফল না পৌঁছায় তাহলে এ প্রবৃদ্ধি অর্থহীন। এ ব্যাপারে আমার মত বা অভিমত  হলো, আমাদের দেশে বিদ্যমান ব্যবস্থাটিই এমন যে, তা কেবল ধনীর উপকারে আসে। এই সিস্টেমে সব মানুষের টাকা পয়সা গুটিকয় লোকের হাতে চলে যাচ্ছে। এবিষয়ে আগে বিশ্বব্যাংক একটা বাঁধাধরা বুলি আওড়াতো। তারা বলতো, এটা (প্রবৃদ্ধির সুফল) আস্তে আস্তে উপর থেকে নিচে নামে। কিন্তু আসলে তা হয় না। গুটিকয়েক মানুষের হাতে জমা হওয়া বা কুক্ষিগত হওয়া টাকা শেষ পর্যন্ত গুটিকয়েক মানুষের  হাতেই কুক্ষিগত থেকে যায়। তারা টাকাটা এতোই যত্ন করে রাখে বা আগলে রাখে বা কুক্ষিগত করে রাখে যে, সে টাকা আর নিচে নেমে আসে না। দরিদ্র মানুষটি পর্যন্ত নেমে আসে না। মানে ‘ট্রিকল ডাউন’ বা চুঁইয়ে পড়া বা ধনকুবের থেকে ধনহীন দরিদ্র মানুষ পর্যন্ত টাকা বা অর্থনীতির সুফল পৌঁছায় না। ‘ট্রিকল ডাউন’ তত্ত্বে এখন কেউ বিশ্বাস করে না। পুরোটাই একটা ফাঁকা বুলি। বিশ্বব্যাংকও এখন আর বলে না।
 
ইব্রাহিম খালেদ বলেন, প্রবৃদ্ধির ধারায় দেশের পার ক্যাপিটা ইনকাম (গড় মাথাপিছু আয়) বাড়বে। কিন্তু পার ক্যাপিটা ইনকাম দিয়ে নিম্ন আয়ের গরিব বা হতদরিদ্র মানুষের তেমন কোনো লাভ আসলে হয় না। পার ক্যাপিটা ইনকাম বাড়ার সুফলটি সে-ই পায় যার টাকা আছে, পুঁজি আছে, সম্পদ আছে। যার টাকা, পুঁজি বা সম্পদ নেই সেই দরিদ্র বা হতদরিদ্র মানুষটির কাছে প্রবৃদ্ধির সুফল ততোটা বা মোটেই পৌঁছাবে না। গরিব আসলে গরিবই থেকে যাবে। রাষ্ট্রকে বা সরকারকে এ নিয়ে ভাবতে হবে। কম আয়ের মানুষকে কিভাবে আরেকটু বেশি আয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া যায় সেটা ভাবতে হবে। যার কোনো আয় নাই, পার ক্যাপিটা ইনকাম বৃদ্ধিতে তার কি যায় আসে! তাই ভাবতে হবে তার জন্য কিভাবে আয়ের পথ করে দেয়া যায় সে ব্যাপারে। তাকে কিভাবে আয় করতে শেখানো যায় বা ব্যবস্থা করে দেওয়া যায় সে নিয়ে ভাবতে হবে। এই বিষয়ে  পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে।  

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আরো বলেন, যে ব্যক্তি ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে, সে কষ্টেসৃষ্টে কোনোমতে খেয়েপড়ে চলতে পারলেও  উপরে উঠতে পারবে না। ওই লোকটাকে যদি ১০ হাজার টাকা বা ১৫ হাজার টাকা লোন দেওয়া হয়, তাহলে সে কষ্ট করে মাসে হয়তো ৫শ টাকা জমা করতে পারবে। এটাকেই তখন আমি অর্ন্তভুক্তিমূলক অর্থায়ন বলবো।  
 
সাবেক এই ডেপুটি গর্ভনর বলেন, সে যদি খেয়ে পড়ে ৫শ টাকা জমাতে না পারে, তাহলে আমি তাকে অর্থায়ন বলবো না। ওই ব্যবস্থা করে দেওয়ার ব্যাপারে আমরা একমত। কোনো আপত্তি নাই। আমাদের দেশে এই খাতে গ্রোথ (প্রবৃদ্ধি) একদমই নাই। বড়লোকদের ঋণে বা  শিল্পেই শুধু  প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। সব সুফল তারাই ভোগ করছে। কিন্তু ছোট ছোট খাতে ঋণ বা প্রবৃদ্ধি একদমই নাই। তার মানে আমরা সঠিক পরিকল্পনার আওতায় আসতে পারছি না।
 
ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এসএমইর বিষয়ে ব্যাংকাররা সব সময় যে আপত্তিটা করে থাকেন, তা হচ্ছে অল্প টাকায় অনেক ঋণগ্রহিতা। এর সুপারভিশন কস্ট অনেক বেশি। এটা সত্য কথা। এই খরচ দিয়ে ব্যাংকের পক্ষে এসএমই কার্যক্রম চালানো কষ্টকর। পরিষ্কার কথা হচ্ছে, এতো বেশি বাড়তি খরচ তাদের পোষায় না। আমি বলেছি, ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে সুপারভিশন কস্টটা কমিয়ে আনতে পারি কিনা।  

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার মনে হয়,এখানে একটা সম্ভাবনা আছে। যেমন বাড়তি কর্মকর্তা বা জনবল নিয়োগ না করেই কিভাবে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম চালানো যায় সেটা আমাদের ভাবতে হবে। সেদিকে আমাদের যেতে হবে। মানে, বাড়তি লোক দিয়ে নয়, বরং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সব কাজ করতে হবে। যেমন যিনি ঋণ নেবেন তিনি মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই নেবেন। সুদও পরিশোধ করবেন। তার কাছে কেবল একটি মোবাইল ফোন থাকলেই হলো। সেই মোবাইলে একজন কর্মকর্তা হেড অফিসে বসে তাকে ফোন করতে পারবেন। বলবেন,  আপনাকে পরশু টাকা দিয়েছি। কত টাকার মাল কিনেছেন। তখন সে (ঋণগ্রহিতা) ভাববে, আমি তো কড়া নজরদারিতে আছি। এতে বেশি কর্মকর্তার নিয়োগ দিতে হলো না। কারণ মোবাইল খরচ এখন অনেক কম। ব্যাংকাররা ইচ্ছে করলে ডিজিটাল পদ্ধতি প্রয়োগ করে সুপারভিশন কস্ট অনেক কমিয়ে আনতে পারেন। তখন ব্যাংকারদেরও আর নেতিবাচক অজুহাত থাকবে না। তারা তখন ঋণ দিতে উদ্বুদ্ধ হবেন। এর মাধ্যমে আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন করতে পারি। এখন সামান্য কিছু মানুষ ব্যাংকিং করে। সবাইকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে না পারলে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন হবে না।
 
প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, এসএমই খাতে ঋণ বিতরণের নিয়ম মানছে না অধিকাংশ ব্যাংক। নির্দেশনা উপেক্ষা করে বেশিরভাগ ব্যাংকই ব্যবসা উপখাতে নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি ঋণ দিচ্ছে। আর উৎপাদন ও সেবা উপখাতে বিতরণ করছে অনেক কম।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৬৩১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৭
এসই/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।