এবারও প্রতিবন্ধীদের সহায়তার নামে সিলেটে চলছে মেলার আয়োজন। আর এসব মেলার নেপথ্যে সেই একই ব্যক্তি আলোচিত মেলা ব্যবসায়ী মঈন খান বাবলু ওরফে মেলা বাবলু।
স্থানীয়রা জানান, মূলত ‘মেলা’ বাবলু এই মেলার আয়োজক। আর অন্ধ কল্যাণ সোসাইটির নাম দিয়ে মেলার ফন্দি কেবল মানুষের সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করা। অনুমোদন না থাকা স্বত্বেও কতিপয় ক্ষমতাসীন নেতার শেল্টারে মেলার আয়োজন করছেন বাবলু।
সিলেটে প্রায়ই এমন ধরনের মেলা আয়োজন নিয়ে ব্যবসায়ীরাও ক্ষুব্ধ। তাদের প্রশ্ন, প্রশাসন যদি অনুমোদন না দিয়ে থাকে, তবে কার শেল্টারে মেলার আয়োজন করা হচ্ছে?
গত ৩০ আগস্ট থেকে চলছে প্যাভিলিয়ন তৈরির কাজ। প্রস্তুতি সম্পন্নের পর ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে মেলা উদ্বোধন হবে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে মেলার আয়োজন করার কথা বলা হলেও এ ব্যাপারে কিছুই জানে না জেলা প্রশাসন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক (ডিসি) নুমেরি জামান বাংলানিউজকে বলেন, সদর উপজেলায় মেলার কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। জেলা প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তাও মেলার অনুমতি দেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইতোপূর্বে সিলেটে বিভিন্ন নামে একাধিক মেলার আয়োজন করা হয়েছে। প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন নেতাদের শেল্টার নিয়ে মেলার আয়োজন করেন বাবলু। মেলা টিকিয়ে রাখতে অর্থমন্ত্রীর নামও ব্যবহার করা হয়েছে বহুবার।
গত বছরের ৮ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের চিকিৎসার খরচ যোগাতে বিভাগীয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম ফটক সংলগ্ন এলাকায় মাসব্যাপী ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প মেলার আয়োজন করা হয়। মেলা থেকে কোটি টাকা আয় হলেও রোগীর স্বজনদের হাতে দুই ধাপে দেওয়া হয় মাত্র ৫ লাখ টাকা। ওই মেলার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে ছিল বাবলুর প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বেনারসি মসলিন অ্যান্ড জামদানি সোসাইটি। এভাবে বিভিন্ন সময় দুস্থ অসহায় রোগীর সাহায্যার্থে করা মেলা থেকে আয়োজক প্রতিষ্ঠানই লাভবান হয়েছেন বলেও জানা যায়।
গত বছরের ৬ জানুয়ারি সিলেট মেট্টোপলিটন চেম্বারের উদ্যোগে মাস ব্যাপী আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন বাবলু। একমাস মেলা চলার কথা থাকলেও দেড় মাস করা হয় এক দুরারোগ্য ব্যধিতে নিহত জনৈক সাংবাদিককে সহায়তার আশ্বাস দিয়ে। কিন্তু ওই সাংবাদিক মারা গেলেও তার পরিবারের হাতে কোনো আর্থিক অনুদান তুলে দেওয়া হয়নি।
গত ঈদুল ফিতরের সময় নগরের টুকেরবাজার তেমুখী সংলগ্ন মাঠে তাঁত বস্ত্র শিল্প মেলার আয়োজন করেন বাবলু। মাসব্যাপী শুরু হওয়া মেলা চলে আড়াই মাস। পবিত্র ঈদুল আজহার সময় মেলার স্থানে পশুর হাট বসিয়ে মেলার সমাপ্তি টানেন বাবলু।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলেট চেম্বার অব কমার্সের এক নেতা বাংলানিউজকে বলেন, আর্থিক সাহায্যের খাত দেখিয়ে সিলেটের মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে মেলার আয়োজন করা হয়। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে মেলার আয়োজন করা হয় ওই খাতকে বঞ্চিত রাখেন উদ্যোক্তারা।
এ বিষয়ে শাহপরান (র.) থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আখতার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, অন্ধ কল্যাণ সোসাইটির নামে জেলা প্রশাসন মেলার অনুমোদন দিয়েছেন। ফলে মেলার নীতিমালা প্রতিপালন সাপেক্ষে মেলার আয়োজনের পুলিশ বাধা দিচ্ছে না। অবশ্য শর্তভঙ্গ করলে মেলা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সিলেট সদর উপজেলার খাদিমপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আফছর আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, মেলার আয়োজকরা বলেছেন মন্ত্রণালয়েরও অনুমোদন আছে। মেলা হলে ইউনিয়ন রাজস্ব পাবে, এ জন্য করতে দিয়েছি। তবে প্রকৃতপক্ষে অনুমোদন আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সিরাজাম মুনীরা বাংলানিউজকে বলেন, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন থেকে মেলার করার বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু আয়োজকরা অনুমোদন পাওয়ার আগেই মেলার আয়োজন শুরু করে দিয়েছে।
সিলেট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, আমি জানি না, অথচ মেলার অনুমোদন দেওয়া হলো কিভাবে? সিলেটে একমাত্র আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা ব্যতিরেকে কোনো মেলা হতে দেওয়া ঠিক না। সিলেটের মানুষের সরলতা নিয়ে নামে বেনামে মেলা করতে দেওয়া যাবে না।
প্রশাসন অনুমোদন দিলেও মেলা বন্ধের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে চেয়ারম্যান আরও বলেন, যে উদ্দেশ্যে মেলা করা হয়, সেই স্বার্থ হাসিল হয় না। বিগত দিনে মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী মারিয়িন চৌধুরী মাম্মীর ছেলের চিকিৎসার অর্থ সংগ্রহে মেলা করা হয়। অথচ এই নারী এখনো ছেলের চিকিৎসা করাতে পারছেন না।
মেলার ইভেনমেনেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মঈন খান বাবলু বাংলানিউজকে বলেন, বিভিন্ন সময় মেলার আয়োজন করলেও তা সহযোগীতার জন্য করে থাকি। আগে তৃণমূল নারী উদ্যোক্তা মেলা থেকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে ৫ লাখ টাকা দিয়েছেন।
ওই মেলার আয়োজন করে নিজে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
এবারের মেলায় স্টল থাকছে ৬০টি, সঙ্গে থাকছে সার্কাস, পুতুল নাচ ও বিভিন্ন ধরণের রাইড।
মেলার আয়োজক বাংলাদেশ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সোসাইটির চেয়ারম্যান এমএ মোশাররফ বাংলানিউজকে বলেন, মেলা করার জন্য আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিয়েছি। জেলা প্রশাসন অনুমতি দেবে। তবে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমোদনের আগে মেলার আয়োজন করা ঠিক হয়নি বলেও স্বীকার করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৮
এনইউ/পিএম/জিপি