তবে ২০১৩ সালে আগর-আতরকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হলেও উৎপাদনে আধুনিক কোনো পদ্ধতি ও পরীক্ষাগার না থাকায় মান নিয়ে সমস্যা, সাইটিস সার্টিফিকেট, এইচএস কোডসহ বিমানবন্দরে নানা জটিলতায় রপ্তানিতে বাধা তৈরি হচ্ছে। ফলে বৈধ পথে রপ্তানির পথ সুগম না হওয়ায় বিকল্প পথে এ পণ্য চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে।
সুজানগরের কয়েকটি কারখানায় রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে একমাত্র শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প হলেও আগর থেকে আতর উৎপাদনে আধুনিক কোনো পদ্ধতি এখনো ব্যবহার হচ্ছে না। এখানে কোনো আধুনিক পরীক্ষাগার নেই। আগর থেকে উৎপাদিত প্রতি তোলা ভাল মানের আতরের দাম ৬ হাজার টাকার বেশি। আর নিম্নমানের আতর আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা তোলা। সে হিসেবে এক লিটার ভালো মানের আতরের বাজারমূল্য ৬ লাখ টাকার বেশি। কিন্তু বন বিভাগের পক্ষ থেকে এ পণ্য রপ্তানিতে সাইটিস সার্টিফিকেট ইস্যুর ক্ষেত্রে জটিলতায় অনেক সময় আন্তর্জাতিক ক্রেতারা অন্য দেশে চলে যায়। এছাড়া বিমানবন্দরে নানা জটিলতায় অনেকে আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এ পণ্য রপ্তানি করছেন। এসব জটিলতা সমাধান করা গেলে আতর দেশের রপ্তানি পণ্যের অন্যতম বৃহৎ খাত হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন রপ্তানিকারকরা।
বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট আনসারুল হক বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকার আতর রপ্তানি হয়ে থাকে। তবে আতর রপ্তানিতে সাইটিস সনদ (বন ও পরিবেশ বিভাগের ছাড়পত্র) সংগ্রহ করতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সময়মতো এ সনদ না পাওয়ায় বিদেশে পণ্য পাঠাতে দেরি হচ্ছে। তাছাড়া আগর-জাত পণ্য রপ্তানির জন্য সাইটিস সার্টিফিকেট ঢাকা বন অফিস থেকে ইস্যু করার স্থলে বড়লেখা বা মৌলভীবাজার বন অফিস থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া কারখানাগুলোয় গ্যাস সমস্যার কারণে উৎপাদনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ শিল্পের অগ্রগতির জন্য পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি গ্যাস বিলিংয়ের ক্ষেত্রে শিল্প হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে বিলিং হলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা উপকৃত হবেন।
প্রায় ৪০০ বছর ধরে বড়লেখা উপজেলার সুজানগরের আগর-আতর ক্লাস্টারের সমাদর রয়েছে। বিষয়টি স্মরণ করিয়ে আনসারুল বলেন, আমাদের তৈরি আতর সৌদি আরব, কুয়েত, ইরাক, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশ এবং ইউরোপে রপ্তানি হচ্ছে। বিদেশে আতরের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও আমরা সে অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছি না। আবার যতটুকু উৎপাদন করছি, তাও সরবরাহ করতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। সুজানগর ঘুরে দেখা যায়, এখনো স্থানীয়ভাবে সনাতন পদ্ধতিতে আগর গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় আতর। গাছ বড় হওয়ার পর সেটি ছোট ছোট টুকরো করা হয়। এসব টুকরো প্রায় এক মাস পর্যন্ত পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হয়। এরপর বড় ডেগে করে চুলার মাধ্যমে ১০-১৫ দিন জ্বালালে সেখান থেকে এক ধরনের রস বের হয়। ওই রসের উপরিভাগের তৈলাক্ত অংশ হাত দিয়ে তুলে উৎপাদন করা হয় আতর। যা প্রক্রিয়াজাতকরণের পর তৈরি হয় মূল্যবান সুগন্ধি আতর। কিন্তু এ আতর এখানে তৈরি হয় না। আগর গাছকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে সংগৃহীত এ নির্যাস বৈধ-অবৈধ পথে চলে যায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। সেখান থেকে আগরের নির্যাস যায় মধ্যপ্রাচ্যে। তবে আগর গাছের কোনো অংশই নষ্ট হয় না। এগুলোর ছাল-বাকলসহ সব অংশই মূল্যবান। বেশি আতর পেতে প্রতিটি আগর গাছে ২ ইঞ্চি পরপর পেরেক মারা হয়ে থাকে।
কথা বলে জানা যায়, বড়লেখার সুজানগর, রফিনগর, বড়থল ও হালিজপুর গ্রামে আগর চাষ হচ্ছে। এখানে ৩৫০টির বেশি ছোট-বড় আতর তৈরির কারখানা রয়েছে। এ শিল্পে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার নারী-পুরুষ। প্রত্যেক শ্রমিক দৈনিক ২৫০-৫০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পেয়ে থাকেন। প্রতি বছর এখানে উৎপাদন হচ্ছে এক থেকে দেড় হাজার লিটার আতর।
এদিকে ২০১০ সাল থেকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের এসএমই ফাউন্ডেশন এ শিল্পের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে আতর উৎপাদনকারীদের দক্ষতা উন্নয়ন, পণ্যের গুণগত মানোন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার জন্য এ শিল্পে নিয়োজিতদের ১০ শতাংশের নিচে ঋণ প্রদান করে আসছে।
এর মধ্যে অবশ্য ২০১৩ সালে আতরকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। ২০১৪ সালে এর আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। ২০১৫ সালে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) উদ্যোগে সরকার এ পণ্যের জন্য একটি এইচএস কোড নির্ধারণ করে দেয়। এসএমই ফাউন্ডেশনও এ শিল্পের অধীনে ৩ কোটি টাকার সহজ শর্তে ঋণ অনুমোদন করে। যা ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৮
জিসিজি/এইচএ/