ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

বড় হচ্ছে রাজশাহীর আম, দুশ্চিন্তায় চাষি

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৯
বড় হচ্ছে রাজশাহীর আম, দুশ্চিন্তায় চাষি রাজশাহীর বাগানগুলোতে গাছে ঝুলছে আম, যা পরিপক্ক হবে অল্পদিনের মধ্যেই

রাজশাহী: বৈশাখের তপ্তমাখা রোদ আর বাতাসে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে রাজশাহীর আম। রৌদ্রতাপ প্রখর প্রকৃতি উপেক্ষা করে প্রতিটি গুটি এখন আমে রূপ নিয়েছে। গাছের শাখা প্রশাখায় দোল খেতে শুরু করেছে সবুজ আমের থোকা। ডালে ডালে তাই স্বপ্ন বুনছেন রাজশাহীর আম চাষিরা। যত্নের মধ্যে কেবলই চলছে পূর্ণতার অপেক্ষা।

তবে বুক ভরা স্বপ্ন থাকলেও এবার মনে শান্তি নেই রাজশাহীর আম চাষিদের। ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রয়োগ ঠেকাতে আম বাগানগুলোতে পুলিশ মোতায়েনের নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট।

কিন্তু রাজশাহীর বাগান মালিকদের দাবি, গাছে থাকতে আমে ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয় না। ফরমালিন বা কেমিক্যাল দেওয়ার ঘটনা ঘটে আমের আড়তগুলোতে। অর্থাৎ পরিপক্কতার পর গাছ থেকে আম ভেঙে নেওয়া হয় আড়তে। সেখানেই অনেক অসাধু ব্যবসায়ী আমে ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রয়োগ করে থাকেন।

রাজশাহীর ছোটবনগ্রাম এলাকার আমচাষি ও ব্যবসায়ী খন্দকার মনিরুজ্জামান মিনার বাংলানিউজকে বলেন, আদালতের নির্দেশনাকে তারা অবশ্যই সাধুবাদ জানান। তবে গাছে থাকা অবস্থায় কোনোভাবেই আমে ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো সম্ভব নয়। এতে পুরো বাগানের ফলনই নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর গাছে থাকার সময় আমের পরিচর্যায় পোকা দমনের জন্য যে রাসায়নিক স্প্রে করা হয় তা ক্ষতিকর নয়। কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ নিয়ে নির্ধারিত পরিমাণেই তা স্প্রে করা হয়। আমে যদি কেউ কেমিক্যাল ব্যবহার করেন তা আম ভাঙার পর আড়ৎ বা গোপন কোনো স্থানে নিয়ে করা হয়। এর দায় কতিপয় অসাধু আড়তদার বা পাইকারি ব্যবসায়ীদের।  

এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মনিরুজ্জামান মিনার বলেন, রাজশাহী বা আশপাশের অঞ্চলের মানুষ পরিপক্ক সবুজ আম আড়ৎ থেকে কিনে নিয়ে যান। তারা বাড়িতে আম সনাতন পদ্ধতিতে বস্তা চাপা দিয়ে বা খড়ের মধ্যে রেখে দেন। এভাবে আমগুলো ধীরে ধীরে পেকে হলুদ বর্ণ ধারণ করে। সেখান থেকে মিষ্টি ঘ্রাণ বের হওয়ার পর খেতে শুরু করেন।  

কিন্তু বাইরের অঞ্চলের মানুষ হলুদ বর্ণের একেবারে পাকা আম না হলে কিনতে চান না। এজন্য অনেক আড়তদার বা পাইকারি ব্যবসায়ীরা এখান থেকে আম ট্রাকে লোড করার আগে মিথানল জাতীয় কেমিক্যাল স্প্রে করে দেন। এতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আমে রং ধরে। আমের গোটা শরীর হলুদ বর্ণ ধারণ করে। তবে মানুষ সচেতন হওয়ায় এই প্রক্রিয়ায় আম পাকানোর কাজ কেউ আর বাগানের প্রকাশ্য এলাকায় করতে পারেন না।  

আর রাজশাহীর ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, আদালতের নির্দেশনা পালনে সবাই শ্রদ্ধাশীল। তবে এ নিয়ে যেন আমচাষিদের কোনোভাবেই হয়রানির শিকার হতে না হয়।

রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজের সচিব জাকির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, উচ্চ আদালতের এই নির্দেশনাকে নিশ্চিত করার জন্য কেউ এমন কিছু না করে যাতে রাজশাহী অঞ্চলের সাধারণ আমচাষি বা ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হন।
রাজশাহীর বাগানগুলোতে গাছে ঝুলছে আম, যা পরিপক্ক হবে অল্পদিনের মধ্যেইএদিকে, বছর ঘুরে ঈদের পরই পরিপক্ক হয়ে গাছ থেকে বাজারের ঝুড়িতে নামবে ‘রাজশাহীর আম’। আমচাষিরা বলছেন, প্রতিবার সময় বেঁধে দিলেও এ বছর এখন পর্যন্ত সেরকম কোনো নির্দেশনা তারা পাননি। তবে কোনো অবস্থাতেই গাছ থেকে তারা অপরিপক্ক আম ভাঙবেন না। আগের সময় মেনেই আম নামানো হবে।

রাজশাহীর পবা উপজেলার পিল্লাপাড়া গ্রামের আম চাষি ও ব্যবসায়ী নূরুল আমিন বাংলানিউজকে বলেন, সাধারণত মধুমাস জ্যৈষ্ঠ শুরুর পর রাজশাহীতে ধীরে ধীরে আম পাকতে শুরু করে। কোনো আম আগে পেকে যায় কোনোটা আবার পরে। তাই বিভিন্ন জাত ও নামের আম পর্যায়ক্রমে নামতে থাকে বাজারে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা মেনে নামানোয় গত বছরও বাজারে প্রায় এক সঙ্গেই হাজির হয়েছিল সব জাতের আম। তবে এবার তেমনটি হবে না। এক এক করে বাজারে নামবে বিভিন্ন জাত ও স্বাদের আম।  

তাই মূলত আগামী ২১ মে থেকে রাজশাহী জেলার সব উপজেলায় আগাম জাতের গুটি আম ভাঙা শুরু হবে। জাতআম খ্যাত গোপালভোগ ভাঙা হবে ঈদের পর। অর্থাৎ জুনের প্রথম সপ্তাহে। পর্যায়ক্রমে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে হিমসাগর, খিরসাপাত ও লক্ষণভোগ আম নামানো হবে। এছাড়া চলতি মৌসুমের আমরূপালি ও ফজলি ১৬ জুন এবং আশ্বিনা জাতের আম ১ জুলাইয়ের পর রাজশাহীর চাষিরা গাছ থেকে ভাঙতে পারবেন।  

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামসুল হক বাংলানিউজকে বলেন, রাজশাহীতে প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে।

এসব জমির বাগান থেকে হেক্টরপ্রতি ১০ থেকে ১২ মেট্রিকটন আম উৎপাদন হয়ে থাকে। সে হিসাবে প্রতি মৌসুমে কমপক্ষে এক লাখ ৭০ হাজার মেট্রিকটন আম উৎপাদন হয়। তবে এবার হেক্টরপ্রতি গড়ে ১৫ দশমিক ৫৮ মেট্রিকটন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে অধিদফতর। চাষিরা এখন আমগাছের নিয়মিত পরিচর্যা করেন এবং যত্ন নেন। তাই প্রতি বছরই ভালো ফলন হয়। এখন আবহাওয়া অনুকূলে থাকলেই হয়। উৎপাদন ভালো হলে আমচাষিদের মুখে হাসি ফুটবে বলেও মন্তব্য করেন শামসুল হক।  

এছাড়া উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী রাজশাহীর আম বাগানগুলো পুলিশের নজরদারির মধ্যে আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন, পুলিশ সুপার (এসপি) মো. শহিদুল্লাহ্। তিনি বলেন রাজশাহীর আম দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে রফতানি হয়। এ কারণে আমে যাতে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর-এমন কোনো কেমিক্যাল ব্যবহার না হয় তা নিশ্চিত করতে এরইমধ্যে বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে।  

এছাড়া জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে বিভিন্ন উপজেলার আম বাগানগুলো মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন পুলিশ সুপার।

রাজশাহী জেলা প্রশাসক এসএম আব্দুল কাদের বাংলানিউজকে বলেন, আম রাজশাহীর একটি অন্যতম অর্থকরী ফসল। এই আম বিক্রি করে স্থানীয় কৃষকরা মেয়ের বিয়ে দেন, ঋণ পরিশোধ করেন, বন্ধকী জমি ছাড়ান। বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর।

তাই ব্যক্তিগতভাবে তিনিও জেলায় আমের ফলন এবং ব্যবসার ব্যাপারে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। এবার আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। যা যথাযথভাবে কার্যকরে কৃষক, ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের সমন্বিত তদারকি কমিটি গঠনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১০০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৯
এসএস/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।