ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা কাপড়-সুতা বাজারে দেদার বিক্রি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৯
শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা কাপড়-সুতা বাজারে দেদার বিক্রি রাজস্ব ভবন

ঢাকা: রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা কাপড়-সুতা এখন অহরহই মিলছে খোলাবাজারে। শুল্ক বিভাগ, শুল্ক গোয়েন্দা, তদন্ত অধিদপ্তরসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিয়মিতই ধরা পড়ছে এসব। দেখা যাচ্ছে, কয়েকটি পোশাক শিল্পের মালিক ও উদ্যোক্তা এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীচক্রের যোগসাজশে এ অপকর্মে লিপ্ত রয়েছেন। এতে বিপাকে পড়েছেন দেশের টেক্সটাইল ও স্পিনিং মিলের মালিকরা। শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা কাপড়-সুতা খোলাবাজারে চলে আসায় তাঁরা অসম প্রতিযোগিতার মুখে রয়েছেন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ঢাকা ও চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর বন্ড দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজধানীর ইসলামপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে গত দুই মাসে প্রায় ৭০ কোটি টাকার এ ধরনের কাপড় আটক করেছে।

ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট গত সোমবারও ইসলামপুর এলাকার একটি মার্কেটে অভিযান চালিয়ে প্রায় ৮০ টন ডেনিম, শার্টিং, স্যুটিং, জর্জেট ফ্যাব্রিকস জব্দ করে।

এসব কাপড়ের বাজারমূল্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। এর আগে গত ৫ অক্টোবর ও ২৫ সেপ্টেম্বর ইসলামপুর এলাকায় চালানো অভিযানে ১৮৪ টন চোরাই বন্ডেড ফ্যাব্রিকস আটক করা হয়েছিল।

ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনার হুমায়ুন কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, বন্ডে আনা কাপড় আটক করতে একের পর এক অভিযান চালানো হচ্ছে। বন্ড দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতরা শক্তিশালী। তাদের আটকাতে বন্ডের কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদদ্য মিলিয়ে অভিযানে শতাধিক লোকবল রাখা হয়। গত দুই মাসে বন্ড দুর্নীতিতে জড়িত আছেন—এমন তিনজনকে আটক করা হয়েছে।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. সহিদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশি ব্যবসায়ীরা সব নিয়ম-কানুন মেনে পণ্য উৎপাদন করছেন। তাঁরা ন্যূনতম লাভ রেখে পণ্য বিক্রি করেন। অথচ সমজাতীয় পণ্য বন্ড সুবিধায় শুল্ক না দিয়ে এনে তার চেয়ে কম দামে বিক্রি করা হয়। অসাধু ব্যবসায়ীদের এ অবৈধ কারবারে দেশি শিল্প লোকসানে পড়ছে। আমরা বিভিন্ন অভিযানে বন্ডে আনা কাপড় ও সুতা আটক করছি। অভিযান আরো জোরদার করা হয়েছে। ’

এনবিআর সূত্র জানায়, গত শতাব্দীর আশির দশকে তৈরি পোশাক খাতের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানির প্রয়োজন পড়ত। বিশেষ করে কাঁচামাল হিসেবে সুতা ও কাপড় আমদানি করা হতো। তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আশির দশক থেকে বন্ড সুবিধায় বিনা শুল্কে কাঁচামাল হিসেবে এসব পণ্য আমদানির সুবিধা দেয় সরকার।

১৯৯০ সালে দেশে সুতা তৈরির কারখানার (স্পিনিং মিল) সংখ্যা ছিল সাতটি। তখন ব্যবসায়ী সংগঠন বিকেএমইএ থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে সুতা কিনতে স্পিনিং মিলের খোঁজ করা হয়েছে। ২০১২ সালেও মোট চাহিদার ৯০ শতাংশ ওভেন, ৪৫ শতাংশ গার্মেন্ট অ্যাকসেসরিজ এবং ৪৫ শতাংশ নিট পণ্য আমদানির প্রয়োজন ছিল। বন্ড সুবিধায় এসব পণ্য আমদানি করা হয়েছে। দিন বদলেছে। ধীরে ধীরে আমদানিনির্ভরতা কমেছে। দেশি শিল্পের সক্ষমতা বেড়েছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সর্বশেষ হিসাবে ইয়ার্ন অর্থাৎ সুতা উৎপাদনকারী স্পিনিং মিলের সংখ্যা ৩৮৪, কাপড় বা ফ্যাব্রিকস কারখানার সংখ্যা ৭৪৫ এবং ডায়িং, ফিনিশিং অ্যান্ড প্রিন্টিং কারখানা ২৩৮টি। আছে কম্পোজিট কারখানাও। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও করছে এসব প্রতিষ্ঠান। অথচ বন্ড দুর্নীতির কারণে এসব শিল্প প্রতিনিয়ত লোকসানে পড়ছে।

এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রথম সহসভাপতি এবং এমবি নিট ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হাতেম কালের কণ্ঠকে বলেন, বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও সরকারের সব নিয়ম-কানুন মেনে দেশি প্রতিষ্ঠান টিকে আছে। এসব প্রতিষ্ঠান শিল্প খাতের কাপড় ও সুতার মোট চাহিদার ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ কাঁচামাল সরবরাহে সক্ষম। অথচ বন্ড সুবিধায় সমজাতীয় পণ্য এনে খোলাবাজারে বিক্রি করায় দেশি প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত লোকসানে পড়ছে। এভাবে অসম প্রযোগিতা চলতে থাকলে দেশি শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।

রাজধানীর ইসলামপুর, হাতেম টাওয়ার, উর্দু রোড, গাউছিয়া, নিউ মার্কেট, টঙ্গী, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, চট্টগ্রামের বকশিবাজারে বন্ড সুবিধায় আনা কাপড় ও সুতার অবৈধ বেচাকেনা বেশি হয়। রাজধানীর বাইরে নরসিংদীর বাবুরহাট, মাধবদী, নারায়ণগঞ্জের টানবাজার এলাকায়, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, এনায়েতপুর, সোহাগপুর, বেলকুচি ও সিরাজগঞ্জে বন্ডের সুতা বেশি বিক্রি হয়।

সরেজমিনে রাজধানীর ইসলামপুর, উর্দু রোড, গুলিস্তান, গাউছিয়া, নিউ মার্কেট এলাকার বিভিন্ন দোকানে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন দোকানে বিনা শুল্কে আনা কাপড়, সুতা কোনো রাখঢাক ছাড়াই বিক্রি হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা নিজস্ব প্রতিনিধি পাঠিয়ে বেশির ভাগ সময়ে আগেই জেনে নিচ্ছে কোন দোকানে কোন পণ্য কতটা প্রয়োজন। কৌশলে সুবিধামতো সময়ে চাহিদামতো পণ্য পৌঁছে দিচ্ছে। দেশে উৎপাদিত সমজাতীয় পণ্যের চেয়ে কম দামে পাওয়ায় খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা আগ্রহের সঙ্গে শুল্কমুক্ত পণ্য কিনছে।

ইসলামপুরে সর্বশেষ অভিযানে ৮০ টন কাপড় জব্দ
সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার ইসলামপুর এলাকায় অবস্থিত গুলশান আরা মার্কেটে পাঁচটি গোপন গুদামে চালানো অভিযানে ৮০ টন কাপড় জব্দ করা হয়।

ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের চালানো এ অভিযান বিকেল ৫টায় শুরু হয়ে গতকাল ভোরে শেষ হয়। অভিযানে পাঁচজন উপকমিশনার ও সহকারী কমিশনারের নেতৃত্বে প্রায় ১০০ জন কাস্টমস বন্ড কর্মকর্তা-কর্মচারী অংশ নেন। ডিএমপি সদর ও স্থানীয় থানার পুলিশ অভিযানে সহায়তা করে। ওই সময় স্থানীয় চোরাকারবারি-সন্ত্রাসীরা সংগঠিত হয়ে অভিযানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। তারা মার্কেটের বাইরের রাস্তা ব্লক করে দেয়, মার্কেটের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং স্লোগান দিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তাদের ওপর হামলার চেষ্টা চালায়।

কমলাপুরে আইসিডি সার্কেলে তিনটি চালান আটক
রাজধানীর কমলাপুরে আইসিডি সার্কেলে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গতকাল শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে আরনি এন্টারপ্রাইজ, ক্রিস্টাল ইমপ্লেক্স ও মেসার্স আল উইন ইন্টারন্যাশনাল নামের তিনটি প্রতিষ্ঠানের তিনটি চালান আটক করেছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য খালাস সাময়িক স্থগিত করা হয়। তাদের আনা পণ্যের দাম শুল্ক-করসহ ৯২ লাখ এক হাজার ৮৪৫ টাকা।

১৩ প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানির তথ্য যাচাই
আমদানি-রপ্তানির তথ্য যাচাইয়ে ১৩ প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানির তথ্য যাচাই পোস্ট ক্লিয়ারেন্স অডিটের আওতায় এনেছে শুল্ক মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেট। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুরোধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন প্রতিষ্ঠানটি এ উদ্যোগ নিয়েছে।

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৯
টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।