ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

অর্থনৈতিক জ্ঞানের অভাবে আশানুরূপ রেমিট্যান্স আসছে না

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৯ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০২০
অর্থনৈতিক জ্ঞানের অভাবে আশানুরূপ রেমিট্যান্স আসছে না .

ঢাকা: বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের মধ্যে দক্ষরা অদক্ষদের তুলনায় বেশি রেমিট্যান্স পাঠান। কিন্তু অদক্ষ কর্মীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠান মূলত পরিবারের ঋণ পরিশোধে। আর দক্ষ অভিবাসীরা সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করতে৷ ফলে দক্ষতার অভাব এবং অর্থনৈতিক জ্ঞানের অভাবে আশানুরূপ রেমিট্যান্স আহরণ হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা’র (আইওএম) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

মঙ্গলবার (১৬ জুন) ‘বাংলাদেশে অভিবাসন, ফ্যামিলি রেমিট্যান্স, সম্পদ এবং দক্ষতার শ্রেণি বিভাগ’ বিষয়ক প্রকাশিত আইওএম'র এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৯ সালে রেমিট্যান্স-নির্ভর এক হাজার পরিবারের ওপর পরিচালিত জরিপ ও মূল অংশীদারদের সঙ্গে গুণগত আলোচনার ফলে উঠে আসা ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে এই প্রতিবেদনে।

সংস্থাটির বাংলাদেশ কার্যালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।  

আইওএম'র প্রতিবেদনে জানানো হয়, উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীরা স্বল্প দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের তুলনায় অধিক অর্থ দেশে পাঠান। দক্ষতা বৃদ্ধির ফলে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছে মাসিক হারে প্রায় ২৫৫ মার্কিন ডলার পর্যন্ত। অভিবাসীদের দক্ষতার ওপর নির্ভর করে রেমিট্যান্স কীভাবে বিনিয়োগ এবং সঞ্চয় করা হবে। দক্ষ অভিবাসীরা পরিবারের সদস্যদের অনুরোধ করেন সঞ্চয় অ্যাকাউন্টে রেমিট্যান্স বিনিয়োগ করতে। উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন অভিবাসী কর্মীরা ভালো বেতনের চাকরিতে নিয়োগ পান এবং দীর্ঘ সময় ধরে স্বল্প দক্ষ কর্মীদের তুলনায় অধিকতর রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন।

অন্যদিকে অদক্ষ অভিবাসীরা তাদের রেমিট্যান্স মূলত লোন পরিশোধে খরচ করেন। রেমিট্যান্স মূলত স্বল্পমেয়াদী প্রয়োজন মেটাতে ব্যবহৃত হয়। সম্পদের বৈচিত্র্য আনতে বা আর্থিক স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করতে খুব কমই ব্যবহৃত হয়, যার ফলে রেমিট্যান্সের ওপর পরিবারের নির্ভরতা আরও বাড়িয়ে তোলে। প্রবাসী এবং তাদের পরিবারের স্বল্প অর্থনৈতিক জ্ঞান তাদের টেকসই উপার্জন, রেমিট্যান্স ব্যবস্থাপনা এবং সম্পদ তৈরির ক্ষেত্রে এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দেয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মী এবং রেমিটেন্স প্রেরকদের মধ্যে অধিকাংশই পুরুষ (৯৮ শতাংশ)। এদের প্রায় ১২ শতাংশ একেবারেই স্কুলে যাননি। আর প্রায় ৮০ শতাংশ পড়াশোনা করেছেন মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত। জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে অর্ধেক অংশ কাজ করেছেন কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির কর্মচারী হিসেবে (৪৯ শতাংশ)। আর প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২৬ শতাংশ) কাজ করেছেন শ্রমিক হিসেবে, যার মধ্যে দিন মজুর ও খণ্ডকালীন শ্রমিক আছেন। বাংলাদেশের অভিবাসী কর্মীরা অন্য দেশের দক্ষ কর্মীদের তুলনায় কম অর্থ পাঠাতে পারেন বা অর্থনৈতিকভাবে কম লাভবান হন। কারণ অদক্ষ এবং স্বল্প দক্ষ কর্মীরা যে পরিমাণ অর্থ পাঠান, তা দক্ষ কর্মীদের তুলনায় অনেক কম।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা এবং চট্টগ্রামে রেমিট্যান্স গ্রহণকারী পরিবারের সংখ্যা সর্বোচ্চ (৭৬ শতাংশ)। রেমিট্যান্স গ্রহণকারী পরিবারের মোট ৬৫ শতাংশ পরিচালনা করেন নারী, যারা মূলত বেকার। সাধারণত রেমিট্যান্সকে তারা অনুৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে খরচ করেন।

গবেষণায় যে সব সুপারিশ উঠে এসেছে তা হলো- প্রথমত, জেন্ডার-সংবেদনশীল দক্ষতা বিকাশের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে এবং পরিবারের অর্থনৈতিক জ্ঞান এবং রেমিট্যান্স পরিচালনার ক্ষমতা তৈরি করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষা এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করতে হবে, যাতে করে স্বল্প দক্ষ অভিবাসী কর্মী আরও বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারে এবং ঋণের চক্র ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে।

তৃতীয়ত, অসহায় অবস্থা হ্রাসে এবং আর্থিক স্বাধীনতার পথে সহায়তায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেন উন্নত ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং সঞ্চয়ের আনুষ্ঠানিকীকরণ নিশ্চিত হয়।

চতুর্থত, নারীদের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক নীতিগ্রহণ করতে হবে। যাতে করে অর্থনীতির পরিমাপ এবং টেকসই কৌশলসমূহ বিবেচনা করে সম্পদ উৎপাদন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।

সবশেষে, অভিবাসী এবং রেমিট্যান্স প্রাপকদের জেন্ডার-সংবেদনশীল অর্থনৈতিক শিক্ষা এবং পরামর্শ দেওয়ার জন্য অংশীদারিত্ব তৈরির সুপারিশ করা হয় এই গবেষণায়।

গবেষণা ফলাফল বিষয়ে আইওএম বাংলাদেশ মিশন প্রধান গিওরগি গিগাওরি বলেন, 'অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন আমাদের মন্দা-প্রভাবিত রেমিট্যান্স নির্ভর মানুষকে সহায়তায় অধিক নজর দিতে হবে। আমাদের অভিবাসী কর্মীদের দক্ষতা বিকাশকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য সরকারকে সহায়তা করা প্রয়োজন। যাতে অভিবাসী কর্মীরা বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে পারে। একই সঙ্গে তাদের পরিবার, বিশেষ করে নারীদের, অর্থনৈতিক শিক্ষা প্রদানে গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে করে রেমিট্যান্স উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগ নিশ্চিত হয় এবং  রেমিট্যান্স নির্ভর পরিবারগুলোর স্থিতিস্থাপকতা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তৈরি হয়। ’

আন্তর্জাতিক ফ্যামিলি রেমিট্যান্স দিবসে উপলক্ষে সকল জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে বিদেশফেরত অভিবাসী কর্মীদের পুনঃরেকত্রীকরণে সহায়তা প্রদান এবং অপবাদ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান জানানো হয় প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ও শ্রম সংকটের ফলে হাজার হাজার অভিবাসী কর্মী বছর শেষে দেশে ফিরে আসবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। মন্দা সংক্রান্ত কারণে চাকরি ছাঁটাইয়ের ফলে শুধু রেমিট্যান্স গ্রহণকারী পরিবারগুলোই নয়, প্রভাবিত হবে তাদের কমিউনিটিও।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো-এর তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০১৯ সালেই সাত লাখ অভিবাসী কর্মী দেশ ছেড়ে বিদেশে যান কর্মসংস্থানের খোঁজে। ২০১৯ সালে প্রবাসীরা বাংলাদেশে ১৮ দশমিক ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠান, যা দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের ৭৩ শতাংশের বেশি আসে উপসাগরীয় দেশসমূহ থেকে। বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ সরাসরি এদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে প্রভাবিত করে এবং অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য একটি লাইফলাইন হিসেবে কাজ করে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৯ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০২০
জিসিজি/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।