ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

গোপালগঞ্জে বাড়ছে ভাসমান সবজি চাষ   

একরামুল কবীর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট   | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০
গোপালগঞ্জে বাড়ছে ভাসমান সবজি চাষ


   ভাসমান পদ্ধতিতে চাষ করা হচ্ছে সবজি, ছবি: বাংলানিউজ

গোপালগঞ্জ: গোপালগঞ্জের নিচু জলাভূমিতে ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রতিবছরই বাড়ছে এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ।

জেলার টুঙ্গিপাড়া উপজেলার মিত্রডাঙ্গা ও বন্যাবাড়ী গ্রাম এখন ভাসমান সবজি গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।  

অন্যান্য গ্রামেও শুরু হয়েছে এ পদ্ধতিতে সবজি আবাদ। এ উপজেলার অধিকাংশ গ্রামের কৃষক কুচুরিপানা দিয়ে বেড (ধাপ) তৈরি করে নানা জাতের সবজি উৎপাদন করছেন। যাতে ব্যবহার করা হচ্ছে না কোনো ধরনের কীটনাশক বা রাসায়নিক।  

বন্যা সহিষ্ণু এ পদ্ধতির সবজির উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত জেলার তিন সহস্রধিক পরিবার। তারা নিজেদের সবজির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অতিরিক্ত সবজি বিক্রি করে বাড়তি উপার্জন করছেন। ফলে সংসারে এসেছে স্বচ্ছলতা ও স্বাচ্ছন্দ্য।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জেলায় ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদনের জন্য ১২ হাজার ৫৬৭টি ও চারা উৎপাদনের জন্য ৫৯০টি ধাপ তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় ১ হাজার ২০০টি, মুকসুদপুরে ৫৫০টি, কাশিয়ানীতে ১২০টি, কোটালীপাড়ায় ৬ হাজার ২০০টি ও টুঙ্গিপাড়া উপজেলায় ৫ হাজার ৮৭টি ধাপ তৈরি করা হয়েছে। এসব ধাপে ঢেঁড়শ, ডাটাশাক, লালশাক, ঝিঙ্গে, করলা, পুঁইশাক, কুমড়া, লাউ, পানিকচু, মরিচ, চিচিঙ্গা ও হলুদ আবাদ করা হয়েছে। এরই মধ্যে এসব সবজি বিক্রি শুরু হয়েছে। আর উৎপাদিত সবজির ভালো দাম পাওয়ায় খুশি কৃষকরা। এ কাজের সঙ্গে জড়িত জেলার ১৩ হাজার ১৫৭টি পরিবার। এতে ৮৫৫ মেট্রিক টন সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া ১ লাখ ৮৯ হাজার লাউ, করলা ও চিচিঙ্গার চারা উৎপাদন করা হয়েছে।

টুঙ্গিপাড়া উপজেলার মিত্রডাঙ্গা গ্রামের রাজীব মোল্লা বলেন, ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ বেশ লাভজনক। এক একটি ধাপ তৈরি করতে ৬০০ টাকা খরচ হয়। আর ১০০ টাকার বীজ লাগে একটি ধাপে। প্রতিটি ধাপ থেকে খরচ বাদে ১০০০ থেকে ১৫০০ হাজার টাকা আয় হয়। ধাপগুলো কচুরিপানা দিয়ে তৈরি করা হয়। ফলে শীতের সময় এসব ধাপের কচুরিপানা পচে জমিটিতে প্রাকৃতিক সারের জোগান দেয়। এতে ওই জমিতে শীতকালীন সবজি উৎপাদন করতে বাড়তি সারের খরচ লাগে না।  

একই গ্রামের পিযুষ বিশ্বাস, অবনী বিশ্বাস, নির্মলা বিশ্বাস, অসিত বিশ্বাস, শক্তি কীর্তনিয়া বলেন, বর্ষার সময় এখানে কোনো কাজ থাকে না। এ সময় কুচুরিপানা দিয়ে ধাপ তৈরি আমরা সবজি চাষ করি। এসব ধাপের সবজি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করা অনেকটা নিরাপদ। এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করতে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার হয় না। উৎপাদন খরচও কম। আবার জমি থেকে পানি নেমে গেলে এসব ধাপ জমিতে দিয়ে শীতকালীন সবজি ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, বোকলি উৎপাদন করা হয়। আমাদের উৎপাদিত সবজির চাহিদা ও দাম সব সময় বেশি। আর এসব সবজি বিক্রি করতে হাট-বাজারে যেতে হয় না। বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এসে জমি থেকে সবজি কিনে নিয়ে যান। সবজি বিক্রি করে আমাদের সংসার ভালোই চলছে।  

একই উপজেলার বন্যাবাড়ী গ্রামের নির্মল বিশ্বাস, প্রণব বিশ্বাস, বিথিকা বিশ্বাস, ফটিক বিশ্বাস বলেন, আমাদের গ্রামের জমি-ক্ষেত অধিকাংশ সময় পানিতে তলিয়ে থাকে। এখানে বছরে একটি মাত্র ফসল হয়। তাই আমাদের দাদা-বাবার সময় থেকে আমরা কুচুরিপানা দিয়ে ধাপ তৈরি করে সবজি উৎপাদন করে আসছি। তখন পরিবারের চাহিদা মেটাতে সবজি উৎপাদন করতাম। বেশ কয়েক বছর হলো কৃষি বিভাগের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আমরা সবজি উৎপাদন করছি। কৃষি বিভাগ আমাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। আর্থিক সহযোগিতাও করছে। এখন আমরা ব্যাপক পরিসরে ধাপ পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন করছি। এতে আমাদের উপার্জনও ভালো হচ্ছে। যা দিয়ে আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে ভালো আছি।

তারা জানান, ৩০ ফুট লম্বা ও সা‌ড়ে ৩ ফুট চওড়া একেকটি ধাপ বানা‌তে খরচ হয় ৬০০-৭০০ টাকা। খরচ বাদে প্রতিটি ধাপ থে‌কে ১০০০ থে‌কে ১৫০০ টাকা আয় হয়। প‌রে ধাপ আবার জৈব সার হি‌সে‌বে ব্যবহার করা হয়। তখন আর সার দি‌তে হয় না জ‌মি‌তে। একেকজন কৃষক ১৫ থে‌কে ২৫টি করে ধাপ তৈরি ক‌রেন। মৌসুমে একেকজন কৃষক প্রায় ১৫ থেকে ৩৭ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকেন।  
 
একই উপজেলার বর্ণি গ্রামের পাইকার ফরিদ শেখ বলেন, টুঙ্গিপাড়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ভাসমান পদ্ধতিতে প্রচুর সবজি উৎপাদিত হয়। এসব গ্রাম থেকে টাটকা সবজি কিনে নিয়ে আমি আশপাশের বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করি। এসব গ্রামের বিষমুক্ত সবজির গুণগত মান ভালো হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে চাহিদা বেশি। দামও ভালো পাওয়া যায়।
 
গোপালগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ড. অরবিন্দ কুমার রায় বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের কৃষি হুমকির মুখে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিনিয়ত আমাদের কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ একটি টেকসই পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে যদি সবজিসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন করা যায়, তাহলে কৃষিতে ঘাটতি কমবে। গোপালগঞ্জে ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি ও মসলা উৎপাদন খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এতে উৎপাদন ব্যয় কম,  লাভও বেশি। বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হয় না। এতে এ অঞ্চলের কৃষকেরা লাভবান হচ্ছেন। প্রতি বছরই ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদে ঝুঁকছেন এ জেলার কৃষক। আর বাড়ছে এ পদ্ধতিতে আবাদ।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।