কুষ্টিয়া: সালাউদ্দিন জিকু। শিক্ষিত বেকার যুবক।
তার এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারা চাষ একেবারেই নতুন ছিল। ফলে সাফল্য পেতে দেরি হয়নি তার। এখন ২০ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন পেয়ারা, মাল্টা, কমলা ও বিভিন্ন উন্নত জাতের কুলসহ বিশাল এক সমন্বিত ফলের বাগান। নানা ধরনের ফলের গাছ দিয়ে তিনি তার বাগান সাজিয়েছেন। বাণিজ্যিকভাবে বাগান করে তিনি সফল হওয়ায় তাকে দেখে অনেক তরুণই এখন ফলের বাগান করেছেন।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ছাতিয়ান ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম আটিগ্রামের সালাউদ্দিন জিকু ফল বাগানে সাফল্য অর্জন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
২০১৬ সালে প্রথম মাত্র বিঘা জমিতে “থাই-৩” জাতের পেয়ারা দিয়ে শুরু করেন বাগান। তিনি ছাড়াও এখন তার বাগানে প্রতিদিন হচ্ছে চারজনের কর্মসংস্থান।
সালাউদ্দিন জিকু বাংলানিউজকে বলেন, পড়ালেখা শেষ করে আমি বিদেশে যাওয়ার জন্য কিছু টাকা জমিয়ে একজনের কাছে দিয়েছিলাম। কিন্তু বিদেশ যাওয়া হয়নি। তাই তিনি আমাকে আমার টাকা ফেরত দিয়ে দেন। তারপর চিন্তা করলাম, আর বিদেশ যাবো না, দেশে থেকেই কিছু একটা করবো। আমি সবাইকে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলাম যে একজন বিদেশে গিয়ে কি করছে, আর আমি মাটি থেকে উৎপাদন করে কি করছি?
তিনি বলেন, শুরুটা সহজ ছিলো না। আমার পাশে কেউ ছিলো না। একেতো বেকার তার ওপর বয়সও কম। তাই বেশ ঝুঁকি নিতে হয়েছিলো। আমার দাদা তখন বেঁচে ছিলেন। দাদাকে পেয়ারা চাষ করে যে লাভ করা যায়, সেটা বিভিন্ন বাগান ঘুরে দেখালাম। তখন দাদার অনুপ্রেরণায় আমি সিদ্ধান্ত নিই। পরে মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রমেশ চন্দ্র ঘোষের সঙ্গে পরামর্শ করি পেয়ারা চাষ সম্পর্কে।
দুই বিঘা জমিতে ‘থাই পেয়ারা-৩’ জাতের পেয়ারা দিয়ে চাষ শুরু করলেও এখন আমার বাগানের পরিধি ২০ বিঘা ছুঁয়েছে। শুরুতে যে টাকা হাতে ছিলো, তা দিয়ে শুধু চাষ আর চারা কেনার টাকাটা হয়েছিলো। দুই বিঘা জমিতে আমি ৪০০ পেয়ারার চারা রোপণ করি। পরে বাগানের চারপাশ ঘেরার জন্য এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ধার করেছিলাম বছরে তাকে ১০ হাজার টাকা বেশি দেওয়ার শর্তে। প্রথমবারেই বেশ ভালো পেয়ারা পাই। সে পেয়ারা বিক্রি করে সেই ৫০ হাজার টাকা শোধ করেও ভালো লাভ ছিলো, যোগ করেন জিকু।
পেয়ারা চাষ সম্পর্কে তিনি বলেন, পেয়ারা চাষের জন্য মাটিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেলে-দোঁয়াশ মাটিতে পেয়ারার ভালো ফলন পাওয়া যায়। তাছাড়া পেয়ারা চাষের জন্য মূলত গাছের পরিচর্যার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কাটিং, পেয়ারা ব্যাগিং করলে ভালো হয়। বর্তমানে আমার ২০ বিঘার ফল বাগানের মধ্যে ১১ বিঘা জমিতে পেয়ারা, আট বিঘা জমিতে বিভিন্ন ধরনের কুল (কাশমেরি-৩ বিঘা, বলসুন্দরী-৫ বিঘা), ১২০টি কমলা গাছ, ১০০টি মালটা গাছসহ বিভিন্ন ফলের গাছ রয়েছে।
তিনি বলেন, কাটিং এবং ব্যগিং করেছি। যাতে করে গাছে ফুল ও ফল বেশি আসে। পেয়ারা গাছে নতুন কুশিতে কুশিতে ফল আসে। আর ব্যাগিং করলে বিষমুক্ত ফল উৎপাদন করা যায়।
পেয়ারা চাষ খুবই লাভজনক। পেয়ারা বাগানে এ বছর প্রচুর পেয়ারা ধরেছে। বিঘা প্রতি প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা লাভ হবে। আর বাজারে পেয়ারার চাহিদাও বেশ ভালো। সারা বছরই প্রায় পেয়ারা ধরে গাছে, বলেন তিনি।
জিকু বলেন, এক বিঘা জমিতে যেখানে ধান চাষ করে বছরে ১০ হাজার টাকা লাভ করা যায় না, সেখানে পেয়ারা চাষ করে লাখ টাকা লাভ করা যায়।
সালাউদ্দিন জিকু এখন নিজেই পেয়ারা, কুল, মালটা, কমলাসহ বিভিন্ন ফলদ গাছের চারা উৎপাদন করে অন্য চাষিদের কাছে বিক্রি করেন। তিনি এখন অন্য যুবকদের কাছে রীতিমতো মডেল। তার চাষাবাদ দেখে অনেকেই পেয়ারা চাষে আগ্রহ দেখিয়েছেন।
একই এলাকার মিরপুর উপজেলার মালিহাদ এলাকার কৃষক জিয়াউর রহমান বাংলানিউজকে জানান, জিকুর পেয়ারা বাগান দেখে আমিও দেড় বিঘা জমিতে পেয়ারা বাগান করেছি। আশা করছি, ভালো পেয়ারা পাবো।
জিকুর মতো পেয়ারা চাষ করে বেশ সাফল্য পেঁয়েছেন মিরপুর উপজেলার গৌড়দহ গ্রামের এনামুল হক। তিনি ছয় বিঘা জমিতে পেয়ারা চাষ করেছেন। গাছ লাগানোর আট মাসের মাথায় ফল এসেছে। বছরে দুইবার তার জমিতে ফল আসে। পেয়ারা চাষ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি ফলের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব বলে বাংলানিউজকে জানান এনামুল হক।
মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রমেশ চন্দ্র ঘোষ বাংলানিউজকে জানান, পেয়ারা চাষ খুবই লাভজনক। বিশেষ করে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারা চাষ করে মিরপুর উপজেলার অনেকেই সাফল্য পেয়েছেন। বৃহত্তর কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চল কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশজ ফল উৎপাদন বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছি। জিকু মিরপুর উপজেলার সফল ফল চাষিদের মধ্যে অন্যতম। তার দেখা দেখি অনেকেই পেয়ারা চাষ করেছেন। বিগত পাঁচ বছরে মিরপুর উপজেলায় ফল উৎপাদন প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। আমরা কৃষক ও তরুণ কৃষি উদ্যোক্তাদের ফল বাগানের ওপর প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিচ্ছি। আশা করি, তাতে ফল উৎপাদন বাড়বে।
বাংলাদেশ সময়:০৮৩৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০২০
এসআই