নাটোর: তিনটি শর্ত পূরণ সাপেক্ষে নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলায় বিসিআইসির সারের গুদাম নির্মাণে প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণের জন্য জমির মালিকদের চার ধারার নোটিশ দিয়েছিল জেলা প্রশাসন।
কিন্তু গত চার বছর অতিবাহিত হলেও ২০ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এ বাফার গুদাম (বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের গুদাম) নির্মাণে কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
এতে একদিকে জমির মালিকরা যেমন জমি বিক্রি করতে পারছেন না। অপরদিকে তারা জমিতে কোনো ফসলও ফলাতে পারছেন না। এমনকি তারা কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে পারছেন না। ফলে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন জমির মালিকরা। তাই তারা পূর্বনির্ধারিত স্থানেই বাফার গুদাম নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন।
জানা যায়, নলডাঙ্গা উপজেলা একটি অনুন্নত এবং অপেক্ষাকৃত দরিদ্র এলাকা হিসেবে পরিচিত। এছাড়া হালতিবিল ও চলনবিল বিধৌত হওয়ায় উপজেলাটি উত্তরাঞ্চলের শস্যভান্ডার হিসেবে খ্যাত। তবে কৃষিনির্ভর এলাকার কৃষকরা সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এরপরও এখানকার উৎপাদিত বিভিন্ন সবজি ও ফসল স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এ এলাকায় সার সংরক্ষণের কোনো গুদাম না থাকায় বোরো মৌসুমে সারের জন্য কৃষকদের অনেক বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়।
এছাড়া সময় ও সুবিধা মতো সার না পাওয়ার কারণে কৃষকদের ফসলের ক্ষতি হয়। পাশাপাশি এলাকায় কোনো শিল্প কারখানা কিংবা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। অথচ এ উপজেলায় কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা স্থাপনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। সড়ক, রেল ও নৌপথ সুবিধা থাকায় জেলার সাতটি উপজেলাসহ দেশের অন্যান্য জেলার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত সহজ ও সুবিধাজনক। এছাড়া অন্যান্য উপজেলার তুলনায় এ এলাকাটি উঁচু ও সমতল হওয়ায় বর্ষায় বন্যামুক্ত থাকে।
এসব বিবেচনায় ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে নাটোর জেলায় ২০ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি বাফার গুদাম নির্মাণের লক্ষ্যে সড়ক, রেল ও নৌপথ যোগাযোগ সুবিধা সম্বলিত ৫ দশমিক ৯৬ একর জমি নির্বাচন করার জন্য বিসিআইসি থেকে নলডাঙ্গা উপজেলাকে বেছে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে জমি নির্বাচন করতে উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) চিঠি দেয় বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ।
ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সরেজমিন তদন্ত সাপেক্ষে বাফার গুদাম নির্মাণের স্থান নির্ধারণ করে ভূমির স্কেচ ম্যাপ ও জমির দাগ নম্বরসহ একটি প্রতিবেদন বিসিআইসিতে দাখিল করেন।
পরে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের নির্দেশে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে ভূমির মালিকদের চার ধারা নোটিশ দেওয়া হয়। এরপর ২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর নাটোর-২ (সদর ও নলডাঙ্গা) আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল বাফার গুদাম নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
কিন্তু গত চার বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও বাফার গুদাম নির্মাণের কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
স্থানীয়দের দাবি, বিসিআইসি কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও একটি স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্তের কারণে গুদাম নির্মাণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনসহ ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম চলমান থাকার কারণে ৪৫ জন কৃষক তাদের জমিতে চাষাবাদ করা থেকে বিরত রয়েছেন। এমনকি জমি কেনাবেচাও বন্ধ রয়েছে। এতে ওই এলাকার ভুক্তভোগী কৃষকরা কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
এ নিয়ে স্থানীয় কৃষক, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধিসহ এলাকার সর্বস্তরের মানুষ পূর্ব নির্ধারিত স্থানে বাফার গুদাম নির্মাণের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। একইসঙ্গে মানববন্ধন ও প্রধানমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী, শিল্প সচিব, বিসিআইসি চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে স্মারকলিপি দেন। এছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল বাফার গুদাম নির্মাণে দুই দফা ডিও লেটার দিয়েছেন। কিন্তু এরপরও গুদাম নির্মাণের প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে ফাইলবন্দি হয়ে আছে।
স্থানীয় কৃষক আব্দুল মজিদ, আলী সরদার ও আহমেদ সরদার জানান, চার ধারা নোটিশ দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে এসব জমির চারপাশে লাল নিশানা দিয়ে চিহ্নিত করা হয় এবং জমিতে চাষাবাদ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। পরে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ে। এতে তারা ওই জমিতে ফসল ফলাতে পারছেন না, জমি বিক্রিও করতে পারছেন না।
তারা আরো জানান, গত আড়াই বছরে এসব জমিতে চাষাবাদ করতে না পারায় প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। জমি কেনাবেচার সুযোগ থাকলেও সরকারি নির্দেশনা না পাওয়ায় জমি বিক্রি করতে পারছেন না তারা। এছাড়া নির্মাণ করতে পারছেন না কোনো স্থাপনা।
নাটোর জেলা জমি হুকুম দখল অফিস সূত্রে জানা যায়, নলডাঙ্গা এলাকায় বাফার গুদাম নির্মাণে জমি অধিগ্রহণের জন্য জমির মালিকদের চার ধারা নোটিশ দেওয়া হয়। এছাড়া জমির মূল্য পরিশোধের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে প্রায় ১৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
নলডাঙ্গা পৌরসভার মেয়র মনিরুজ্জামান বলেন, নলডাঙ্গা উপজেলায় কোনো ভারী শিল্পকারখানা নেই। এখানে বাফার গুদাম নির্মাণ করা হলে এলাকাবাসীর একটি স্বপ্ন পূরণ হবে এবং কর্মসংস্থানের পথ সুগম হবে। পাশাপাশি হালতিবিল, চলনবিলসহ রাজশাহীর বাগমারা, পুঠিয়া, নওগাঁর আত্রাই, রানীনগরসহ বিভিন্ন এলাকায় সঠিক ও সুবিধামতো সময়ে সার সরবরাহের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে একদিকে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, অপরদিকে কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবেন।
নাটোর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বাংলানিউজকে জানান, বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। আশা করছি, শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে শিগগিরই এ ব্যাপারে নির্দেশনা আসবে। সেখান থেকে নির্দেশনা পেলে বাফার গুদাম নির্মাণ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করা হবে।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) চেয়ারম্যান শাহ মো. এমদাদুল হক বাংলানিউজকে জানান, শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বরত সচিব জাকিয়া সুলতানা বাংলানিউজকে জানান, নলডাঙ্গায় বাফার গুদাম নির্মাণ প্রক্রিয়া চলমান আছে। এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। বিষয়টি বিবেচনায় আছে।
নাটোর-২ (সদর ও নলডাঙ্গা) আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল বাংলানিউজকে জানান, নলডাঙ্গা উপজেলায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের শর্তের তিনটি সড়ক, নৌ ও রেলপথ রয়েছে। তিনি বাফার গুদাম নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। তিনি আশাবাদী যে পূর্বনির্ধারিত স্থানেই বাফার গুদাম নির্মাণ করা হবে। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে তার পক্ষ থেকে বারবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৪ ঘণ্টা, নভেম্বর, ২৬, ২০২১
এসআই