ঢাকা: করোনা সংক্রমণের মধ্যে অর্থনীতি ক্রমোশ পুনরুদ্ধারের দিকে গেলেও কিছু দুর্বলতা এ প্রক্রিয়াকে টেকসই হতে বাধাগ্রস্ত করছে। এখন আবার চোখ রাঙাতে শুরু করেছে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ‘ওমিক্রন’।
জানুয়ারিতে (২০২১) যে অনিশ্চিয়তার মধ্যে দিয়ে বছর শুরু হয়েছিল, ২০২২ সাল তার চেয়ে ভালো হবে বলে বিশ্বাস অর্থনীতিবিদদের। তারা জানান, সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারের দিকে যেতে হবে। যেমন ব্যাংকিং খাত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন রয়েছে। অভ্যন্তরীণ খাতগুলোতেও নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট মোকাবিলায় টিকা কার্যক্রম পুরোদমে চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
করোনা মহামারির মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠেছে বাংলাদেশ। এর ফলে ২০২৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অর্থনীতির অন্যতম সূচকগুলো রেমিট্যান্সের বড় উত্থানে গত বছর শুরু হয়। রপ্তানি আয় বছরের শুরুতে কম থাকলেও বছরের শেষে বড় উত্থান হয়েছে। রিজার্ভও মোটামুটি ভালো রয়েছে। তবে আমদানিতে বড় উত্থান হওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। এর মধ্যেও দেশে বৈষম্য ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। তবে অর্থনীতির সূচকগুলোর উত্থান-পতন সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতি ভালো রয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনায় সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার মান নিচে নেমে গেছে। বিশেষ করে করোনায় যারা কর্মহীন হয়ে পড়েছিল, তাদের অবস্থা খারাপ। সরকার তাদের জন্য নানা সুবিধা ঘোষণা করলেও কোনো কাজে আসছে না। দেশের ৮৫ ভাগ মানুষের হাতে কিছু নেই। ১৫ ভাগ মানুষের হাতে অধিকাংশ সম্পদ বড় বৈষম্য সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশে প্রথাগত ভঙ্গুরতার পাশাপাশি করোনা মহামারি নতুন ভঙ্গুরতা তৈরি করেছে। বাংলাদেশের গড় আয় নিয়ে উচ্ছ্বাস করার কিছু নেই। কেননা বৈষম্যের চিত্র ভিন্ন। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ফের চোখ রাঙাচ্ছে।
তারা বলেন, যেভাবেই হোক এ ভ্যারিয়েন্টকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকারের ‘ফাস্ট প্রায়োরিটি’ হবে করোনা মোকাবিলা। টিকা কার্যক্রমে দীর্ঘ সূত্রিতা- সমন্বয়হীনতা করলে চলবে না। সব মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলানিউজকে বলেন, ২০২১ সালটা নানা ধরনের অনিশ্চয়তা দিয়ে শুরু হলেও সার্বিকভাবে গত বছরের তুলনায় একটু স্বস্তিতেই শেষ হচ্ছে। তবে অনেকেই করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারলেও সবাই সেটা পারছে না। বেশ কিছু জায়গায় এখনও দুর্বলতা রয়ে গেছে। ফলে মূল্যস্ফীতির নাভিশ্বাস সাধারণ মানুষের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। কারণ মানুষের আয় কমে গেছে। দারিদ্রের হার যতোটা বেড়েছিল সেটা আগের অবস্থায় যায়নি। সরকার এ নিয়ে কাজ করছে।
চলতি বছর দেশীয় খাত একটি বৈষম্যমূলক রিকভারির মধ্যে রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ক্ষুদ্র, মাঝারি খাত, নারী উদ্যোক্তা, প্রান্তিক মানুষ আস্তে আস্তে রিকভার করছে, তবে বড় খাতগুলো যেভাবে করছে তারা সেভাবে পারছে না। এজন্য সরকারকে লোন পরিশোধের টাইমলাইন বাড়িয়ে দিতে হবে।
প্রবৃদ্ধি ও রেমিট্যান্স বিষয়ে তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বলতে হবে আগের বছরের থেকে এ বছরের প্রবৃদ্ধি ভালো হবে। রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা আপাতত পতন বলা যায়। গত বছর যে অস্বাভাবিক রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল, সে গতি বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ বর্তমানে আগের সিস্টেমে চলে গেছে এ খাতটি। তাই চিন্তার কারণ নেই।
বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারকে আরও নজর দিতে হবে জানিয়ে মোয়াজ্জেম বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনায় ই- কমার্স, পরিবহন খাত, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সারা বছর দেশের জনগণকে ভুগিয়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো বাজার তদারকি সঠিকভাবে না হওয়া। সুতরাং এ বছর সরকারের উচিত হবে বাজার ব্যবস্থাপনায় প্রতিযোগিতা নিয়ে আসা। মনিটরিং বাড়ানো, দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
২০২২ সাল কেমন যাবে উল্লেখ করে এ গবেষক বলেন, এখনো বড় বাধা হচ্ছে করোনা। এজন্য গত বছর যেভাবে সরকার অর্থনীতি কর্মকাণ্ড চালিয়েছে সামনের দিনগুলোতেও সেভাবে সীমিত আকারে অর্থনীতির কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে হবে। এজন্য সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। এজন্য অভ্যন্তরীণ খাতগুলোতে নজর দিতে হবে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে কৃষি পণ্য বলতে ধানের উৎপাদনের পুন:মূল্যায়ন দরকার। অন্যান্য ক্ষেত্রে যারা বড় বড় আমদানিকারক তারা এখনও বাজারে একটা গেইম খেলছে, তাদের ক্ষেত্রে সরকারের একটা ভূমিকা রাখথে হবে। পাশাপাশি ওমিক্রনের প্রভাব কাটাতে সরকারকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এজন্য
প্রয়োজনে বিশেষ প্রণোদনাসহ বিভিন্ন প্যাকেজ ঘোষণার জন্য আর্থিক সংস্থান সরকারের হাতে রাখতে হবে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার করতে হবে জানিয়ে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকারকে কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারের দিকে যেতে হবে। যেমন ব্যাংকিং খাতের সংস্কার প্রতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন রয়েছে। সংস্কারের দুর্বলতার কারণে অনেক জায়গাতে ব্যয় বাড়ছে সে দায় সরকারকে নিতে হচ্ছে। যেটা সরকার মেটাতে অপারগ।
রেমিট্যান্স: গত বছর জানুয়ারি মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৯৬ কোটি ডলার। এ রেমিট্যান্স আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। আর গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় এবারে একই মাসে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বেড়েছিল ২ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। তবে ধস নামে নভেম্বরে এসে। এ মাসে ১৫৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত বছরের নভেম্বরে পাঠিয়েছিলেন ২০৭ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। আগের মাস অক্টোবরে এসেছিল ১৬৪ কোটি ৬৮ লাখ ডলার। এ অঙ্ক গত দেড় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। আর গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে কম ২৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। আগের মাস অক্টোবরের চেয়ে কম এসেছে ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। সব মিলিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এ সূচক কমেছে ২১ শতাংশ।
রপ্তানি: শুরুতে রপ্তানি আয় কম থাকলেও শেষে রেকর্ড হারে বেড়েছে। জানুয়ারি মাসে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছিল ৩৪৩ কোটি ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ শতাংশ কম ছিল। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের জানুয়ারি মাসের তুলনায় চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জানুয়ারি মাসে রপ্তানি আয় প্রায় ৫ শতাংশ পিছিয়ে ছিল। তবে বছরের শেষে এসে এর উল্টো চিত্র দেখা গেছে। নভেম্বর মাসে এসে রপ্তানি আয় এসেছে ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার।
আমদানি বেড়েছে রেকর্ড হারে: রপ্তানি আয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আমদানি ব্যয়। রেকর্ডের পর রেকর্ড হচ্ছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে ৭০০ কোটি ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৫০ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি। চলতি ২০২১-২২ অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিক অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ৮৭২ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এ অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি।
বেড়েছে বৈষম্য: করোনার মধ্যেও কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ব্যাপক হারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে দেখা যায়, বর্তমানে কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৩৯ জনে। ২০২১ সালের জুন শেষে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৯৯ হাজার ৯১৮ জন। অর্থাৎ তিন মাসে ব্যাংক ব্যবস্থায় নতুন কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ৩২১ জন।
রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৪৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার: রেমিট্যান্স কমায় বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভেও প্রভাব পড়েছে। আমদানি বাড়ার পরও গত ২৪ আগস্ট আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ১৪৪ কোটি ৮০ লাখ (প্রায় ১.৪৫ বিলিয়ন) ডলার এসডিআর (স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস) ঋণ রিজার্ভে যোগ হওয়ায় এক লাফে তা বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। রপ্তানি বাড়ায় কয়েক দিনে অবশ্য তা কিছুটা বেড়ে ৪৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে তিন গুণ: আমদানিতে বড় ধরনের উল্লম্ফন দেখা দেওয়ায় বাণিজ্যে বড় ঘাটতিতে পড়েছে দেশ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বাংলাদেশে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯১০ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের বাণিজ্য ঘাটতির চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যন্ত্রপাতি আমদানির কারণে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়লে কোনো সমস্যা নেই। এতে দেশের জন্য ভালোই হবে। অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। আমদানি বৃদ্ধি পাচ্ছে মানে দেশের অবকাঠামো উন্নত হচ্ছে, কর্মসংস্থান হচ্ছে। আর কর্মসংস্থান হলে মানুষের হাতে টাকা আসবে। তখন তারা সেই টাকা খরচ করবে। এটা অর্থনীতির জন্য ভালো।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১,২০২১
জিসিজি/জেডএ