ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

১০০ টাকার তরমুজ ৬০০ টাকা, লাগাম টানবে কে?

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০২২
১০০ টাকার তরমুজ ৬০০ টাকা, লাগাম টানবে কে?

রাজশাহী: মোকাম থেকে পিস হিসেবে কিনে আনা হচ্ছে তরমুজ। কিন্তু সেই তরমুজ ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে কেজি দরে।

এতে দামের মধ্যে এমনিতেই বিস্তর ফারাক হয়ে যাচ্ছে। কৃষকের জমিতে যে তরমুজ কেনা হচ্ছে ১০০ টাকায়। সেই তরমুজ ভোক্তাদের কাছে আসতেই দাম হয়ে যাচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। ফলে সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে এ সহজলভ্য গ্রীষ্মকালীন ফল।

কয়েকগুণ বেশি দাম দিয়েই একজন ক্রেতাকে নিতে হচ্ছে তরমুজের স্বাদ। অথচ এ বাড়তি দামের সুফল গ্রামের প্রান্তিক চাষিদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। হাড়ভাঙা শ্রম দেওয়া তৃণমূলের তরমুজ চাষিদের রক্ত শুষে খাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। মৌসুমের আগে ও শুরুতে যে দাম মাথায় নিয়ে বাজারে এসেছিল তরমুজ, এখন ভরা মৌসুমে সেই দামই আছে।

বাজারে ৩০০ টাকার নিচে ছোট একটি তরমুজও কেনা যাচ্ছে না। গরিবের এ মৌসুমি ফলটিও তাই এখন কেবল বড়লোকের ইফতারের প্লেটেই শোভা বাড়াচ্ছে। সমাজের বড় অংশে থাকা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ দাম দর করেই হাপিত্যেশ করছেন।

এ হচ্ছে চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমের দেশি সহজলভ্য কম দামের সবার জনপ্রিয় রসালো ফল তরমুজের হালহকিকত। গেল কয়েক বছর থেকে তরমুজের বিক্রি প্রক্রিয়া ও দাম নিয়ে চরম অরাজকতা চললেও দেখার যেন কেউই নেই।

পবিত্র এ রমজান মাসে কাঠফাটা রোদ-গরমে রোজাদারের প্রাণ যায়যায় অবস্থা। সারাদিন সিয়াম সাধনার পর ইফতারে রসালো এ ফল পাতে রাখতে চাইছেন কমবেশি সবাই।

কিন্তু দামের কারণে সাধ ও সাধ্যের মিশেল করতে ব্যর্থ হচ্ছেন অধিকাংশ মানুষই। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হরহামেশাই তরমুজ নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়ছেন অনেকে। বাজার নিয়ন্ত্রণ রাখতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রায় দিনই অভিযান চালাচ্ছে তরমুজের বাজারে।

কিন্তু মূল্য তালিকা প্রদর্শন নিয়ে অর্থদণ্ড দেওয়া হলেও যথাযথ তথ্য প্রমাণের অভাবে ঠিকায় তরমুজ কিনে কেজি দরে তরমুজ বিক্রির অরাজকতা বন্ধ করতে পারছে না। তাই হরদম জরিমানা গুনলেও কেজি দরেই তরমুজ বিক্রি করছেন রাজশাহীসহ গোটা দেশের ব্যবসায়ীরা। সেই কেজির দামও আবার আকাশ ছোঁয়া। আরও অবাক করার বিষয় হচ্ছে এলাকা, স্থান বা বাজার যেখানেই হোক দাম একই। কী রাজশাহী, কী ঢাকা। তরমুজের দাম প্রতি কেজি ৬০ টাকা।

শালবাগান বাজারে তরমুজ কিনতে আসা মধ্যবয়সী সেলিম উল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, এ তো ৩ থেকে ৪ বছর আগেও পিস হিসেবে তরমুজ কিনেছেন। কিন্তু নতুন নিয়ম কীভাবে হলো কেউ বলতে পারছেন না। কেজি হিসেবে কিনতে গেলে ৫০০ টাকার নিচে কোনো ভালো তরমুজ নেই। ছোট একটি তরমুজ কিনলেও ৩০০ টাকা লাগছে। কিন্তু ছোট তরমুজ বেশিরভাগই কাঁচা। তাই মাঝারি বা তরমুজ কেনা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এজন্য অনেকে দাম দর করেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। এখন যাদের সামর্থ্য আছে তারাই কেবল তরমুজ কিনতে পারছেন। দেশি এ ফলটিও নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ কিনে খেতে পারছেন না বলে আক্ষেপ করেন শহরের এ ক্রেতা।

উত্তরের বিভাগীয় শহর রাজশাহীর সবচেয়ে বড় তরমুজের আড়তগুলো রয়েছে শালবাগান বাজারে। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় সবগুলো আড়তই এখানে। এছাড়া রাজশাহী শহরে পাঁচ শতাধিক স্পটে খুচরা ও পাইকারি তরমুজ বিক্রি হচ্ছে। আড়তগুলো বলছে, তারা মণ হিসেবে কিনে কেজি হিসেবে বিক্রি করছেন। তারা বরগুনা, গলাচিপা ও পটুয়াখালী থেকে ট্রাকে করে তরমুজ নিয়ে আসেন এবং কমিশনে বিক্রি করেন। এখানকার সাতটি পাইকারি তরমুজের আড়তে একই কায়দায় তরমুজ বিক্রি হচ্ছে।

এখানকার অন্যতম একটি তরমুজের আড়ত একতা এন্টারপ্রাইজ। এর স্বত্বাধিকারী ইলিয়াস ব্যাপারী বাংলানিউজকে বলেন, রাজশাহীর প্রায় সব আড়তেরই তরমুজের মোকাম হচ্ছে বরিশাল ও পটুয়াখালী। মূলত কৃষকের জমি থেকে মোকামে পিস হিসেবে তরমুজ সংগ্রহ করা হয়।

কিন্তু বরিশাল ও পটুয়াখালীর মোকাম থেকে রাজশাহীসহ সারাদেশে মণ বা কেজি হিসেবেই তরমুজ কেনাবেচা হয়। তারা কমিশন ভিত্তিতে ব্যবসা করেন। এক মণ তরমুজে ১০০ টাকা কমিশন। এখান থেকে মণ হিসেবে কিনে কেজি হিসেবে বিক্রি করেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।

তিনি আরও জানান, পাইকারি ১ হাজার ৬০০ টাকা মণ দরে তারা এখন তরমুজ বিক্রি করছেন। অর্থাৎ খুচরা ব্যবসায়ীরা ৪০ টাকা কেজি দরে এখান থেকে তরমুজ কিনছেন। পরে ৪৫ থেকে সর্বোচ্চ ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। এখন পাওয়া যাচ্ছে বাংলালিংক, হলুদ তরমুজ ও জাপানি জাতের কালো তরমুজ।

শালবাগান এলাকার খুচরা তরমুজ ব্যবসায়ী আব্দুল ওহাব বাংলানিউজকে জানান, পাইকারি আড়ত থেকে তরমুজ বেছে নিতে দেওয়া হয় না। তাই তারা পাইকারি তরমুজ কিনে বড়, মাঝারি ও ছোট এ তিন ভাগে ভাগ করেন। এরপর আকার ভেদে ছোট তরমুজ (৩-৫ কেজি) ৪৫ টাকা, মাঝারি আকৃতির (৬-৮ কেজি) ৫৫ টাকা ও বড় আকৃতির (৮-১২+ কেজি) তরমুজ কেজিপ্রতি ৬০ টাকায় বিক্রি করছেন। বাংলালিংক ও জাপানি কালোজাতের দাম একই। আর হলুদ তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি।

এদিকে তরমুজের দাম নিয়ে অরাজকতা প্রশ্নে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রাজশাহী কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক হাসান-আল-মারুফ বাংলানিউজকে বলেন, পিস হিসেবে তরমুজ বিক্রির কথা শোনা গেলেও বাস্তবে তারা এর কোনো প্রমাণ পাচ্ছেন না। তারা নিয়মিতভাবে মহানগরের তরমুজের আড়ত ও খুচরা দোকানগুলোয় অভিযান পরিচালনা করছেন। সেখানে ব্যবসায়ীরা যেই পাকা চালান দেখাচ্ছেন তাতে পিস হিসেবে কোনো তরমুজের কেনাবেচা নেই। থাকছে মণ বা কেজি হিসেবে। এজন্য পিস না কেজি সেই প্রশ্নে তাদের করার কিছু নেই।

আর এখন পর্যন্ত কৃষিপণ্য ও বিপণন থেকে তরমুজের কেজি প্রতি নির্দিষ্ট মূল্য না থাকায় বিষয়টি নির্ণয় করে দেওয়া তাদের পক্ষে আইনগতভাবে সম্ভব নয়। তারা মূলত তিনটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করেন। প্রথমটি হচ্ছে- বাজার দরের চেয়ে কেউ তরমুজ কিনে তার চেয়ে বেশি দরে বিক্রি করছেন কিনা, তরমুজের মূল্য তালিকা থাকছে কিনা ও কেউ কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছেন কিনা। কেউ বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি দামে তরমুজ বিক্রি করলে বা মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করলে তারা প্রচলিত আইনে অর্থদণ্ড দিচ্ছেন বলেও উল্লেখ করেন রাজশাহী ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এ কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০২২
এসএস/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।